সাঈদ মোহাম্মদ আনোয়ার, উখিয়া::
১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনে দেশে ভূমি হস্তান্তর দলিলের নিবন্ধন করা হয়। উপজেলা পর্যায়ে সাব রেজিস্ট্রার আইন অনুযায়ী ভূমি নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করে থাকেন, যার জন্য রয়েছে তার নিজস্ব দপ্তর। জনগুরুত্বপূর্ণ এই দপ্তর নিয়ে ‘ভূমি দলিল নিবন্ধন সেবায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক’ এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। আলোচিত গবেষণাটিতে তুলে ধরা হয়েছে সাব রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের বাস্তব চিত্র, যেখানে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ করাতে পারেন না সেবাগ্রহীতারা।
দলিল নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় প্রতারণা ও জালিয়াতি, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, স্থানীয় রাজনৈতিক ও নানাবিধ প্রভাব বিস্তার, সময়ক্ষেপণ ইত্যাদি নানা কৌশলের ফাঁদে ফেলে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার মতো সুস্পষ্ট তথ্য উপাত্ত রয়েছে উক্ত প্রতিবেদনে।
মাঠ পর্যায়ে যার স্বাক্ষ্য দিচ্ছে দুর্নীতির আতুর ঘর খ্যাত কক্সবাজারের উখিয়ার সাব-রেজিস্ট্রার অফিস। কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ কতিপয় দালালদের নিয়ন্ত্রিত সিন্ডিকেটের কালো থাবায় পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সীমান্তবর্তী এই উপজেলার সাধারণ মানুষদের। এদের সাথে মানুষ হয়রানীতে আরও যোগ হয়েছে অসাধু কিছু দলিল লেখক।
রত্না পালং এর সুমন বড়ুয়া নামে একজন বলেছেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা না মেনে অনৈতিক ভাবে মামলাধীন জমি রেজিষ্ট্রি কার্যক্রম সম্পাদন করেছে উখিয়া সাব-রেজিস্টার। যার মামলা নং অপর ১৩৫/২০২৩। মৌজা রত্নাপালং, আরএস ১১৪২ খতিয়ানের আরএস দাগ ৭৩, ৭৬, বিএস ৩৩ নং খতিয়ানের বিএস ৮৯, ৯০, ৯৬, ৯৭ দাগের বিরোধীয় জমি রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন।
ঘুষ আদায়ে রেস্টুরেন্টের মতো ম্যানু কার্ট!
ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সরকারি ফির বাইরেও জমির মূল্যের দশমিক ৫ শতাংশ ( প্রতি লাখে ৫%) অর্থ দিতে হবে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য। অর্থাৎ জমির মূল্য ১ কোটি টাকা হলে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য নেওয়া হয় ৫০ হাজার টাকা।
একইভাবে অন্যান্য সেবাখাতেও দিতে হয় কমিশন, আছে সেবা অনুযায়ী নির্ধারিত অংক! অনেকটা রেস্টুরেন্টের ম্যানু কার্টের মতো অদৃশ্য এই অনৈতিক অর্থ আদায়ের তালিকা পরিণত হয়েছে নিজস্ব নিয়মে।
এ ব্যাপারে হলদিয়া পালং এর পলাশ বড়ুয়া নামে একজন বলেছেন, উখিয়া সাব-রেজিস্টার অফিস কেন্দ্রিক দালালের দৌরাত্ম্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। তাদের মাধ্যমে সরকারি নির্ধারিত ফি’র বাইরেও ক্ষেত্র বিশেষে ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত খরচ গুণতে হয়। এসব নিরসন এখন সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। একই ধরণের কথা বলেছেন, রত্নাপালং এর বেলাল ও শিমুল কান্তিসহ বেশ কয়েকজন।
রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলে অনিয়ম:
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এবং বাজারমূল্য কম দেখিয়ে দলিল নিবন্ধন করে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অভিযোগ রয়েছে এই দপ্তর ঘিরে জন্ম নেওয়া অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারী, অসাধু দলিল লেখক ও দালাল চক্র সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রতিবছর গড়ে ৩৫ লাখের বেশি দলিল নিবন্ধন হয়। এতে রাজস্ব আয় হয় বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। সিন্ডিকেটে জড়িত দলিল লেখকরা দপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সেবাগ্রহীতাদের বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে দলিলে প্রকৃত মূল্য তুলে ধরেন না বলে জানান এক ভুক্তভোগী।
ঘুষের টাকার ভাগ, কার পকেটে ডুকে কত?
দলিল রেজিষ্ট্রেশন আইন সম্পর্কে জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগে দলিল নিবন্ধনে ঘুষ বাবদ আদায় করা অর্থ ভাগ করে নেন উখিয়া সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের কালো সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলিল লেখক ও সংশ্লিষ্ট দালালেরা।
অভিযোগ আছে, এখানকার দলিল লেখকেরাই দলিল করার সময় অফিস খরচের অজুহাতে অনেক বেশি বাড়তি টাকা নেন। জানা যায়, ঘুষের ২৫ শতাংশই নেন অফিস সহকারী নেবী রাণী দে। ৫০ শতাংশ দেন সাব-রেজিস্ট্রার, বাকী ২৫% অন্যদের মধ্যে। এছাড়াও সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের যে কোনো পদে চাকরি পেলেই অল্প সময়ে হয়ে যাচ্ছেন কোটিপতি। দলিল লেখকরাও এর বাইরে নয়। সাব রেজিস্ট্রার অফিসে রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরের পর যিনি টিপ সই নেন। তিনি পান দলিল প্রতি ১০০-২০০ টাকা, যিনি রশিদ লিখেন দেন তিনিও পান ২০০ টাকা। মোহরার চাকরি যারা করেন তারা পান ১৫০০ টাকা। কোট ফি নামে রেজিস্ট্রার নেন দলিল প্রতি ১০ থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত। সেখানে কোন কাগজ প্রিন্ট করতে গেলে বা তাদের লোক দিয়ে কাগজ প্রিন্ট করান সেক্ষেত্রে প্রতি কপি ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা দিতে হয়।
লুটের মালের মতো দলিল লেখকরা যার কাছ থেকে যা নিতে পারেন। ৫ থেকে ৩০ /৪০/৫০ হাজারও নিচ্ছেন। আর বিভিন্ন ধরণের খরচ দেখিয়ে সরকারী ত্রাণ লুটপাটের মতো যা নিতে পারেন, সেটি ভিন্ন। তারা আপনাকে বলবেন আপনি এসব জানেন না, এটা অফিস খরচ দিতে হয়। এসব দেখেই তো বিএসএস ক্যাডারের চাকরি ছেড়ে নন বিসিএস ক্যাডার অর্থাৎ সাব রেজিস্ট্রার অফিসে যোগদানের মতো ঘটনাও এদেশে ঘটে যাচ্ছে।
অনিয়মের মাস্টারমাইন্ড দলিল লেখকরা!
জমির দলিল নিবন্ধনের ক্ষেত্রে দলিল লেখকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, উখিয়ায় নিবন্ধিত দলিল লেখকের সংখ্যা ২০ জন, তৎ মধ্যে একজন মারা গেছেন, অন্য একজন অবসরে চলে গেছেন। বর্তমানে নিবন্ধিত দলিল লেখক রয়েছে ১৮ জন। আবার তাদের রয়েছে অঘোষিত ১৮ জন সহকারী। এর বাহিরেও রয়েছে স্বঘোষিত ১০ জন এর মতো অবৈধ দালাল দলিল লেখক। যাদের নেই কোন অভিজ্ঞতা ও নেই কোন দলিল লেখকের সরকারি অনুমতিপত্র। এরা অবৈধ টাকা ইনকাম করার জন্য জায়গা ক্রেতার সাথে দলিল সম্পন্ন করে দেওয়ার কথা বলে কন্টাক্ট (চুক্তিতে) কাজ নিয়ে নেন, পরে ভুল ভাল দলিল একটা লিখে, কাজ কম আছে এমন দলিল লেখকদের কাছ থেকে কোন ভাবে স্বাক্ষর একটা নিয়ে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সাথে মোটা অংকের টাকা লেনদেনের মাধ্যমে উক্ত দলিল গুলো সম্পাদন করে থাকে। অজ্ঞ দালাল চক্রের হাতে পড়ে দলিল রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করার কারনে অনেক জমি ক্রেতা রাতারাতি ফকির হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়াও ভুল দলিল হওয়ার কারনে জমি শর্ত ঠিক করতে প্রায় সকলকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে, এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে থানা মামলায় জড়িয়ে পড়ে। এতে করে বাড়ছে থানায় ও আদালতে মামলার চাপ। পাশাপাশি বিএস খতিয়ান করতে গিয়ে জমির ক্রেতাকে ঘুণতে হয় মোটা অংকের ঘুষ। নিয়ম অনুযায়ী শুধু মাত্র নিবন্ধিত দলিল লেখকরাই জমির ক্রেতা-বিক্রেতার চাহিদা অনুসারে দলিল লেখেন। এর জন্য নির্ধারিত হারে পারিশ্রমিক নেওয়ার কথা। এদিকে উখিয়া সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সরকারি ভাবে কর্মরত আছেন ১ জন সাব রেজিস্ট্রার, ১ জন অফিস সহকারী, ২ জন মোহরার, ১ জন টিসি মোহরার ও ১ জন পিওন। সরকারি নিয়োগের বাহিরে অবৈধ ভাবে নকল নবীস (অতিরিক্ত মোহরার) নামে ১২ জন ও অফিস কার্যসহকারী নামে ২ জন স্টাফ। যাদের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায় অফিসের গোপন তথ্য।
১৯৯৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় থেকে দলিল লেখকদের পারিশ্রমিকের হার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। কিন্তু দলিল লেখকেরা সে নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেবাগ্রহীতাদের থেকে ইচ্ছেমতো টাকা নেন। না দিলে নানাভাবে হয়রানি করেন বিভিন্ন অজুহাতে।
প্রতিটি সাব-কবলা দলিল রেজিস্ট্রি করতে প্রথমে সাব-রেজিস্ট্রারের জন্য ২ হাজার টাকা, দলিল লেখক সমিতির নামে ১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। প্রতি হেবা দলিলে সরকারি চার্জ ১ হাজার ৫০০ টাকা হলেও নেওয়া হয় ৭-৮ হাজার টাকা অথবা ক্ষেত্র বিশেষে চাওয়া হয় আরো বেশি।
বড়কর্তা কে পাওয়া যায় না দপ্তরে!
মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, উখিয়ার সাব রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তা তার দপ্তরে থাকেন না বেশির ভাগ সময়।
পরপর তিন কর্মদিবস গিয়েও তার দেখা মিলেনি। প্রথম দিন এক কর্মচারী জানান তিনি কক্সবাজারে গিয়েছেন মিটিংয়ে, পরদিন শুনতে হয় ” স্যার ছুটিতে আছেন, এর পরেদিন, স্যার এখন ব্যস্ত পরে আসেন ।”
ওয়েবসাইটের তথ্য গড়মিল:
দপ্তরে যেমন দুর্নীতির কালো হাতের রয়েছে আঁচড়, ঠিক তেমনি বেহাল অবস্থা দেখা গেলো গুরুত্বপূর্ণ এই জনদপ্তরের সরকারি ওয়েবসাইটে।
১০ বছর আগে যোগদান করা সাব রেজিস্ট্রার এর নাম এখনো আছে সেখানে, অথচ খোজ নিয়ে জানা গেছে এই সময়কালে অন্তত ৫ জন উখিয়ায় সাব রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছেন।
এসব বিষয়ে মোরশেদের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি, সর্বশেষ একবার রিং হওয়ার পরও তিনি রিসিভ করেন নি।
স্থানীয় সচেতন মহল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিকট দাবী জানিয়েছেন, দলিল লেখকদের দলিল প্রতি মিনিমাম সাড়ে ৭% ফি নির্ধারিত থাকা এবং টাকার বিপরিতে রিসিটের ব্যবস্থা করা, যেমন বেতনের বাইরে যদি কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত টাকা দিতেই হয়। প্রয়োজনে প্রকাশ্যে অফিস ফি নির্ধারণ করা যা রিসিটের মাধ্যমে নেওয়ার ব্যবস্থা করা। আর না হয় সাব রেজিস্ট্রার অফিসে ঘুষ বানিজ্য বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সাব রেজিস্টার কর্তৃক এখন দলিল হবে না বলে ঘুষ নির্ধারণ পদ্ধতি বাতিলে পদক্ষেপ নেওয়া। সব চেয়ে বড় ঘুৃষের বানিজ্য টি করার জন্য দলিল লেখকরা বলে থাকেন, এই দলিলে কত টাকা লাগবে বড় স্যার দেখে যা বলেন তা দিতে হবে এই উক্তির মাধ্যমে। এছাড়াও রয়েছে জনসাধারণের সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ।
উখিয়া দলিল লেখক সমিতির সভাপতি শাহজাহান মোবাইল ফোনে জানান, ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকে উখিয়ার দলিল লেখকগণ ও সাব রেজিস্ট্রার অফিসের স্টাফরা কোন ধরনের অনিয়মের সাথে আপাতত জড়িত নেই বললেই চলে। তবে এখনো ভুয়া দলিল লেখক পরিচয়দানকারী কিছু অসাধু চক্রের অপতৎপরতা এখনও কমেনি।
পাঠকের মতামত: