কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

অনুমতি মিললে আজই লন্ডন নেওয়া হবে খালেদাকে

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে গতকাল বুধবার আবেদন করা হয়েছে তার পরিবারের পক্ষ থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখা হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে, অনুমতি মেলা মাত্র সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডন নেওয়া হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আজ বৃহস্পতিবার যেকোনো সময় চার্টার্ড বিমানে করে সিঙ্গাপুর হয়ে লন্ডন নেওয়া হবে। সঙ্গে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দল এবং পরিবারের সদস্যরা থাকবেন। তাকে হাসপাতাল থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স রেডি রাখা হয়েছে।

এদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া ভালো নেই। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াও নানা শারীরিক সমস্যা রয়েছে তার। এর মধ্যেই সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ফুসফুস থেকে দুবার পানি অপসারণ করা হয়েছে। হার্টে সমস্যা আছে। ডায়াবেটিসের মাত্রাও বেশি। এ ছাড়া আর্থ্রাইটিস এবং আরও কিছু সমস্যাও আছে। তার শরীরের অবস্থা যেকোনো সময় ‘খুবই খারাপ’ হয়ে যেতে পারে, এমন শঙ্কাও রয়েছে। এটিই বেশি ভাবাচ্ছে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসায় ১০ চিকিৎসক নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ডকে।

এরই মধ্যে গতকাল রাতে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বিএনপির এই শীর্ষনেত্রীর শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় তার এনজিওগ্রাম করানো দরকার বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু তার শরীরের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করছে মেডিকেল বোর্ড। বোর্ডের পক্ষ থেকে বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতা এবং খালেদা জিয়ার পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমনটিই জানানো হয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের কোভিড আক্রান্ত হওয়ার কারণে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, একই ধরনের সমস্যার কারণে দ্বিতীয় দফার পরীক্ষায় ফল নেগেটিভ আসার পরও অনেক করোনা রোগীর জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ সমস্যাটা তীব্র হয়ে থাকে। এ বিষয়টি নিয়েই চিকিৎসকদের ভয় বেশি।

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা বলেছেন, শুধু করোনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তাকে নিয়ে যত ‘ভয়’। নইলে তার যে সমস্যাগুলো আছে তা খুব জটিল কিছু নয়। বয়স একটি বড় ফ্যাক্টর। ৭৬ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপারসনের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে, ডায়াবেটিস মাত্রা অনেক বেশি। যার কারণে তিনি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। কারণ এ সমস্যাগুলো করোনার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে তীব্র করতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকেও তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ চলছে। এরই মধ্যে গতকাল বুধবার রাতে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে এ সংক্রান্ত আবেদন করেন। রাত সাড়ে আটটায় তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় যান। তিনি ফিরে যাওয়ার পর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের ছোট ভাই একটি আবেদন দিয়েছেন। সেটা আমি গ্রহণ করেছি। আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। তারা বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের যে নির্দেশনা দেবে, সে অনুযায়ী আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। তিনি আরও বলেন, তার (খালেদা জিয়ার) উন্নত চিকিৎসার প্রয়োাজন হলে বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখব।

এর আগে গত সোমবার রাতেও শামীম এস্কাদার ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে টেলিফোনে খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলাপ করেন। তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতা গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে হলে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ- এক. খালেদা জিয়ার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে; দুই. সরকারের অনুমতির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি এবং তিন. করোনা পরিস্থিতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো দেশ তাকে প্রবেশের অনুমতি দেবে কিনা? উপরন্তু তিনি করোনা রোগী। এসব প্রশ্নের উত্তর মিললে তার বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

সরকার সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সরকার অবগত আছে। তাকে দেশের বাইরে নিতে চাইলে সরকার অনুমতি দেবে। কিন্তু যে আদেশে তিনি জেল থেকে বের হয়েছিলেন, সে অনুযায়ী তার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করলে আদালত তাকে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারেন।

গত বছরের মার্চে বিদেশে চিকিৎসার জন্য মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিল খালেদা জিয়ার পরিবার। চিঠিতে বেগম জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ নিয়ে যেতে চান বলে উল্লেখ করেছিলেন। সেই চিঠির ভিত্তিতে মুক্তির আদেশ সংশোধন করলে তাকে বিদেশ নেওয়া সম্ভব বলে মনে করেন তার আইনজীবীরা।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে খালেদা জিয়ার রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদনগুলো আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়- High Sensitive Troponin-1 রিপোর্ট ভালো আসেনি। এ ক্ষেত্রে একজন নারীর স্বাভাবিক রেফারেন্স মাত্রা ধরা হয় ১৫.৬-এর কম। বেগম জিয়ার সেই মাত্রা ২১.২। এই রিপোর্টের মাধ্যমে তার হার্টের অবস্থা নির্ণয় করা হয়। রক্ত জমাট বাঁধছে কিনা জানতে উ-উরসবৎ পরীক্ষা করা হয়। এর স্বাভাবিক রেফারেন্স মাত্রা ৫০০-এর নিচে। বেগম জিয়ার তা ২১৩৪.৩। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তা রক্ত জমাট বাঁধার ইঙ্গিত দেয়। তার হিমোগ্লোবিন মাত্র ৭.৭। স্বাভাবিক অবস্থায় তা ১১.৫-১৬.৫-এর মধ্যে থাকার কথা। NT- pro BNP পরীক্ষাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। স্বাভাবিকভাবে ১২৫-এর কম থাকতে হয়। বেগম জিয়ার রক্ত পরীক্ষায় তা ২২৩৮ এসেছে। এই পরীক্ষার রিপোর্ট তার হার্ট ও ফুসফুসের অস্বাভাবিক অবস্থা বোঝাচ্ছে।

এ ছাড়া CA 125 পরীক্ষার উচ্চমাত্রা একটি জটিল রোগের ঝুঁকি নির্ণয় করে। ওই পরীক্ষার স্বাভাবিক মাত্রা ১২৫-এর নিচে হলেও বেগম জিয়ার তা ৯৬২। এ দ্বারা শুধু ওই জটিল রোগের ঝুঁকির মাত্রা বোঝায়। তবে তার শরীরে দুরারোগ্য কোনো ব্যাধির অস্তিত্ব নেই। তবে এ রিপোর্টগুলো স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকলেও তাতে ‘সর্বোচ্চ’ ঝুঁকি নেই। তবে করোনা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে এ সমস্যাগুলো তীব্র হতে পারে। সেটি চিকিৎসকদের কাছে চিন্তার মূল কারণ।

খালেদা জিয়াকে শ্বাসকষ্টের কারণে সিসিইউতে স্থানান্তরের খবরে দলের নেতাকর্মীরা বেশ উৎকণ্ঠায় আছেন। তার শারীরিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার দাবি জানিয়েছেন নেতারা। দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলছেন- বিএনপি চেয়ারপারসনকে যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের যেকোনো একটি দেশে নেওয়ার বিষয়ে দল এবং পরিবারের মধ্যে আলোচনা আছে।

গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এএম আমিনউদ্দিন জানান, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে যেতে হলে আদালতের সম্মতি লাগবে। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ (১) ধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। এখন এটা (বিদেশ নিতে) করতে গেলে আদালতে আসতে হবে।

তিনি আরও বলেন, উনার (খালেদা জিয়ার) চিকিৎসা কতটুকু প্রয়োজন। বাংলাদেশে কী আছে, না আছে, সবকিছু দেখে সরকার বিবেচনা করবে। সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে, যদি আইন অনুযায়ী প্রয়োজন হয়, তা হলে সরকার আদালতে আসবে। কারণ এটা তো সরকারি আদেশ, সরকারই এটা ঠিক করবে।

পাঠকের মতামত: