কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে ইউনিক আইডি

দেশের তিন কোটির বেশি শিক্ষার্থীর জন্য ইউনিক আইডি (একক পরিচয়) তৈরি করছে সরকার। পাঁচ বছর বয়সী প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থী থেকে ১৭ বছর বয়সের দ্বাদশ শ্রেণির সব ছাত্র-ছাত্রী পাবে এই ইউনিক আইডি। এই আইডিতে ১০ বা ১৬ ডিজিটের শিক্ষার্থী শনাক্ত নম্বর থাকবে, যা পরবর্তীতে হবে ওই শিক্ষার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে আলাদা করে তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন হবে না। ২০২০ সাল থেকে শিক্ষার্থী শনাক্ত করার ইউনিক আইডি দেওয়া শুরু হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সমন্বিত ও কার্যকর সিআরভিএস ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রত্যেক নাগরিকের একটি ইউনিক আইডি তৈরি করার নির্দেশনার আট বছর পর এই প্রথম শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ইউনিক আইডি করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। শিক্ষার্থীর ইউনিক আইডিতে বিদ্যমান জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে বেশি তথ্যের সংযোজন থাকবে। ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ (সিআরভিএস) বাস্তবায়নের আলোকে এই আইডি দেবে সরকার।

সূত্রমতে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘প্রাথমিক শিক্ষার্থীরদের জন্য প্রোফাইল প্রণয়ন’ এবং শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (IEIMS)’ শীর্ষক দুটি প্রকল্পের আওতায় এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন জেনারেলের কার্যালয় ও নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনিআইডি) অনুবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি দফতরের সহায়তায় এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রোফাইল প্রণয়ন’ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ বছর বয়সী প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে ভর্তি হওয়া ১০ বছর বয়সী পঞ্চম শ্রেণির এক কোটি ৮৭ লাখ শিক্ষার্থীর সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হবে। জন্ম নিবন্ধন সনদের তথ্যসহ যাবতীয় তথ্য বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হবে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এসব তথ্য সংগ্রহের কাজ করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ১৬৪ কোটি টাকার প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। পাঁচ বছর বয়সী প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একটা ডাটাবেইসের আওতায় নেওয়া হবে। জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী শিশুর বয়স যখন পাঁচ বছর হবে তখন থেকেই একটি সিস্টেমে নেওয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে এর আওতায় আনা হবে। শিক্ষার্থীরা একটি আইডেন্টিফিকেশন নম্বর পাবে। এই নম্বরটিই পরবর্তী সময় জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরে রূপান্তরিত হবে। প্রাথমিকের যারা আইন্টিফিকেশন নম্বর পাওয়ার পর মাধ্যমিকে ভর্তি হবে এবং মাধ্যমিকের পর কলেজে ভর্তি হবে তখন পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক ও কলেজের কাছে এই তথ্য চলে যাবে। শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর হলে এনআইডির অনুবিভাগের আওতায় চলে যাবে তার তথ্য। এই সিস্টেমে কোনও তথ্য ডুপ্লিকেশনের সুযোগ নেই। সিআরভিএস বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই এটি করা হচ্ছে। দেশের সব নাগরিকের জন্য একক পরিচয় নিশ্চিত হবে এই সিস্টেমে।’

মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সিআরভিএস এর আলোকে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এক কোটি ৮৭ লাখ শিশুর প্রোফাইল তৈরি করা হবে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়েছে, প্রকল্প শেষ হবে ২০২১ সালে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিআরভিএস বাস্তবায়নের সঙ্গে এটি যুক্ত হবে।

এদিকে ব্যানবেইস সূত্রে জানা গেছে, ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত (১১ থেকে ১৭ বছর) প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে ইউনিক আইডি। ২০২০ সাল থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে। ব্যানবেইস এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৩১৩ কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে একনেক। সমন্বিত এই প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে অধ্যাপক শামসুল আলমকে নিয়োগ করা হয়েছে।

‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ‘রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককেই চিহ্নিত করার মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তথ্য নিবন্ধিত করা এবং এর ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করার নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়াই হচ্ছে সিআরভিএস। আন্তর্জাতিকভাবে জন্ম, মৃত্যু, মৃত্যুর কারণ, বিবাহ, তালাক এবং দত্তক এই ছয়টি বিষয়ই সিআরভিএস এর অংশ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশে সিআরভিএস এ এই ছয়টির পাশাপাশি আরও মাইগ্রেশন, এনরোলমেন্ট এবং সার্ভিস ডেলিভারি এই তিনটি বিষয় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। এটাকে আমরা বলছি সিআরভিএস প্লাস প্লাস।’

অধ্যাপক শামসুল আলম আর বলেন, ‘এটি একটি সিটিজেন ডাটা স্টাকচার। এই ডাটা স্ট্রাকচারের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর সব তথ্য থাকবে। এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে গেলে শুধু ইউআইডি নম্বর দিলেই সব তথ্য পাওয়া যাবে। নতুন করে কোনও তথ্য প্রয়োজন হবে না। সরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ইউআইডি নম্বর চেক করলেই সব তথ্য পাবে। এখানে কোনও তথ্য ভুল হওয়ার সুযোগ নেই এবং নকল করার সুযোগ থাকবে না। এই ডাটাবেইসে তার সারা জীবনের তথ্য সংযোজিত হবে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব তথ্যই থাকবে। একটি সময়ে গিয়ে দেশের সব মানুষ এই ডাটাবেইসের মধ্যে চলে আসবে। জনসংখ্যার পরিসংখ্যান করতে নতুন করে কোনও সময় ও অর্থ ব্যয় হবে না।’

অধ্যাপক শামসুল আলম জানান, এই ডাটাবেইসে শিক্ষার্থীর ফল, কোন বিষয়ে ভালো এবং তার ব্যক্তি জীবনের অনেক তথ্যই থাকবে। চাকরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই ডাটাবেস কাজে লাগবে। শনাক্ত নম্বরটি দিলেই সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতর তার তথ্য জানতে পারবে।

ব্যানবেইস সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা বিশেষ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে আগে থেকেই সিআরভিএস কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তবে এসব কার্যক্রমে অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এরই পথ ধরে কার্যকর সিআরভিএস ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সিআরভিএস ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে সিআরভিএস সংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটি গঠন হয়। পরের বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সিআরভিএস সচিবালয় গঠন হয়। সিআরভিএস সংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশনায় এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের সহায়তায় ‘সিআরভিএস সচিবালয়’ সিআরভিএস বাস্তবায়নের কাজ করছে।

প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, ‘শিশুদের জন্ম সনদ রয়েছে। কিন্তু যারা স্কুল গোয়িং তাদের শনাক্তকরণ কীভাবে হবে? আর যদি ধরি জন্ম সনদ রয়েছে, তাতেও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অনেকেরই একাধিক জন্ম সনদ রয়েছে। সে কারণে স্কুলগোয়িং শিশুদের থেকে এটি শুরু করা হচ্ছে। দেশে কত শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে তা জানা যাবে সহজে। কোনও শিক্ষার্থী অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলে তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায় না। ধরে নেওয়া হয় ঝরে গেছে। এই ইউনিক আইডিটা ১০ ডিজিট হবে না ১৭ ডিজিটি হবে সেটি নির্ধারণ করা হবে জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে। কারণ কাজটি তাদেরই করতে হবে। আর এই আইডিটাই যখন শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তখন এনআইডিতে রূপান্তর হবে। নম্বর একই থাকবে।’ সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত: