কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়

আজ ভয়াল ‘সিডর’ দিবস

আজ ১৫ নভেম্বর ভয়াল ‘সিডর’ দিবস। ২০০৭ সালের ওই রাতে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরের’ আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়ে শত শত মানুষ, গবাদি পশু ও বন্যপ্রাণীর জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিলো। নিখোঁজ হয়েছিলো বহু মানুষ। দূর্যোগের আগের দিনও যে জনপদ ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, প্রাণচাঞ্চল্য ছিল শিশু কিশোরদের, মাঠজুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ। পরের দিনই সেই জনপদ পরিণত হয় মৃত্যুকুপে। ১৩ বছর পর সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন সেখানকার মানুষ। তাদের অধিকাংশই হারিয়েছেন স্বজন। এখনো সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন তারা। উপকূলের মানুষের স্মৃতিতে এখনো ভেসে ওঠে শত শত মানুষের আত্মচিৎকার আর স্বজনদের আহাজারি। এখনো সন্তানহারা পিতা-মাতা, পিতা-মাতাহারা সন্তানরা এখনো পথের দিকে তাকিয়ে আছে, হয়তো বা তারা ফিরে আবার আসবে এই আশায়।

১৫ নভেম্বর ২০০৭ ভয়াল ওই দিনে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলাসহ গোটা দক্ষিণা লের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ২১৫ থেকে ২৩০ কিলোমিটার বেগে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরের’ তান্ডবে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। ওইদিন রাত সাড়ে ১০ টার দিকে বঙ্গোপসাগরের সব জল জম দূতের মতো এসে মানুষগুলোকে নাকানি-চুবানী দিয়ে কেড়ে নিতে শুরু করলো। মাত্র ১০ মিনিটের জলোচ্ছ্বাসে উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলো। সকালে মনে হলো যেন কেয়ামত হয়ে গেছে। চারিদিকে শুধু ধ্বংসলীলা। লাশের পর লাশ পাওয়া যাচ্ছে। কবর দেবার মত কোন জায়গা পাওয়া যাচ্ছিলো না। সেদিন এক একটি কবরে ২/৩ জনের লাশ ফেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো। সেদিন সমগ্র উপকূল ঝুড়ে ছিল শুধু ধ্বংসযজ্ঞ আর লাশের স্তুপ।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় ‘সিডরের’ আঘাতে বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৫০১ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো। গৃহহীন হয়ে পড়েছিলো ৮৯ হাজার ৭৮৫টি পরিবার। এরমধ্যে আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৩৮৬ জন মানুষ সেদিন প্রাণ হারিয়েছিলো। জলোচ্ছ্বাসে দু’উপজেলার ৭০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছিলো। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো ১৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। সম্পূর্ন বিধ্বস্ত হয়েছিল ১৩৯ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

সুপার সাইক্লোন ‘সিডরের’ ক্ষত চিহ্ন আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা। সিডরের ২ দিন পূর্বে আমতলী উপজেলার ঘটখালী ও বৈঠাকাটা গ্রাম থেকে ১৪ জন দিন মজুর পানের বরজের জন্য ধানশিলতা সংগ্রহে ট্রলার যোগে বঙ্গোবসাগরে সুন্দরবন এলাকার দুবলারচরে যায়। সিডরের ভয়াল রাতে তাদেরকে ট্রলারসহ ভাসিয়ে নিয়ে যায় দু’উপজেলার উপড় দিয়ে বয়ে যাওয়া পায়রা (বুড়িশ্বর) নদীর মোহনা সংলগ্ন টেংরাগিরি বনের কাছে। এদের মধ্য থেকে সেদিন ৪ জন জীবিত অবস্থায় ফিরে আসলেও আজো পর্যন্ত বাকী ১০ জন ফিরে আসেনি। এরা হলো ইউসুফ (৪০), জব্বার (৫৫), সোবাহান (৪২), হোসেন (৫০), খলিল (৩৫), রতন (৪০), সোহেল (১৮), মনিরুল (২৫), দেলোয়ার (২৫) ও আলতাফ (২০)। স্বজনদের হারিয়ে অসহায় এই পরিবারগুলো এখনো মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

‘সিডরে’ নিখোঁজ ইউসুফের স্ত্রী আমেনা বেগম কান্নারত অবস্থায় বলেন, মোর স্বামী বড় বইন্যার ২ দিন আগে সাগরে গেছে পানের বরজের লইগ্যা লতা কাটতে। হেইহানে বইয়া বইন্যায় হ্যারেসহ লগের সব মানষেরে পানতে ভাষাইয়া লইয়া গ্যাছে। আজ পর্যন্ত ফিইর‌্যা আয় নাই। এ্যাহন পোলাপান লইয়া অনেক কষ্টে দিন কাডাইতেছি।

প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ দিবসে স্বজনহারা মানুষরা মিলাদ মাহফিল, দোয়া মোনাজাত, কোরআনখানি ও নানাবিধ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটিকে স্মরণ করে থাকে। এছাড়া দু’উপজেলার বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সেচ্ছাসেবী সংগঠন নিহতদের স্বরন করে মোমবাতি প্রজ্বলন ও শোক র‌্যালী করে দিবসটি পালন করেন।

পাঠকের মতামত: