কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

আহমদ শফী: হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমীরের সঙ্গে সরকারের সখ্যতা বাংলাদেশকে আরও ইসলামীকরণ করেছে?

গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন কওমী মাদ্রাসা-ভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফী। চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে তিনি অনেকের কাছেই শ্রদ্ধা পেয়েছেন। রাজনীতিতে তিনি আলোড়ন তোলেন ২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় বিশাল এক সমাবেশ করে। তবে দ্রুতই তিনি সরকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং এমন কিছু দাবি আদায় করে নেন, যা বাংলাদেশকে আরও বেশি ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যায় বলে তার অনেক সমালোচক মনে করেন। বিশ্লেষন করেছেন বিবিসি বাংলার আকবর হোসেন।

এখন থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে, গণভবনে আলেমদের এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেন।

ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলতে হেফাজতে ইসলাম যে দাবি তুলেছিল, তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্টের সামনে মূর্তি আমিও পছন্দ করিনি।”

ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফীসহ কওমী মাদ্রাসার নেতৃবৃন্দ।

প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর হেফাজতে ইসলাম নেতাদের চোখেমুখে দৃশ্যত এক ধরনের প্রশান্তি দেখা গিয়েছিল, যা ফুটে উঠেছিল টেলিভিশনের পর্দায়।

একই অনুষ্ঠানে কওমী মাদ্রাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’ শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার মাস্টার্সের সমান মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

হেফাজতে ইসলামের আমীর ও চট্টগ্রামের প্রভাবশালী হাটহাজারী মাদ্রাসার সাবেক পরিচালক আহমদ শফী গত শুক্রবারে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার আগে ছাত্র আন্দোলনের মুখে তিনি মাদ্রাসায় তার পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।

২০১৩ সালের পর থেকে গত সাত বছরে হেফাজতে ইসলামের বেশ কিছু দাবি কার্যতঃ সরকার মেনে নিয়েছে।

তবে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দাবির প্রতি সরকার কর্ণপাত করেনি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ণ, নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।

এছাড়া ‘কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা’ করার দাবিও সরকার আমলে নেয়নি।

কিন্তু তারপরেও ইসলামপন্থী এই সংগঠনের ভেতরের অনেকেই মনে করেন, ওই সময়ের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতা হিসেবে আহমদ শফী যতগুলো দাবি সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাতে সক্ষম হয়েছেন, সেটি অতীতে কখনো হয়নি।

ক্ষমতাসীনদের সাথে সমঝোতা করেই হোক আর চাপ প্রয়োগ করেই হোক, হেফাজতের দাবি মানাতে সক্ষম হয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত আমীর আহমদ শফী।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া ২০১৭ সালের মার্চ মাসের এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম স্বীকার করেছিলেন যে হেফাজতে ইসলামের সাথে সরকারের এক ধরণের আপোষ হয়েছে।

“রাজনীতিতে বলুন, সরকার পরিচালনায় বলুন, সবসময়ই ছোটখাটো অনেক সময় আপোষ করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থে। যেমন, এর আগে নারী নীতি নিয়ে কথা হয়েছিল। তখন আমি নিজেই আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বসেছি, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি,” বলছিলেন মি. ইমাম।

তিনি বলেন, “তারপর শিক্ষানীতি নিয়ে যখন কথা হয়েছে, তখন আমাদের সরকারের থেকে ক্যাবিনেটেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে যে এই নীতিমালাগুলোতে এমন কিছুই থাকবে না, যেটি শরিয়া পরিপন্থী, কোরান হাদিসের পরিপন্থী। আসলে থাকেওনি।”

“তার ফলে বিষয়টিকে বলতে পারি, ডিফিউজ করা হয়ে গেছে। না হলে এটা একটা খারাপ রূপ ধারণ করতে পারতো। ঐ সুযোগটি তো আমরা দেবো না।”

বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম যেসব দাবি উত্থাপন করেছিল, সেগুলোর মধ্য দিয়ে আহমদ শফী কার্যত বাংলাদেশে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং গতিপ্রকৃতিতে একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন।

ঢাকার শাপলা চত্বরে একটি সমাবেশ আয়োজনের মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলামের উত্থান হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে তাদের খুব বেশি সময় লাগেনি।

‘নাস্তিক ব্লগারদের’ শাস্তির দাবিতে হেফাজতে ইসলাম শুরুতে মাঠে নামলেও বেশ দ্রুত তাদের দাবির সংখ্যা বাড়তে থাকে।

সবচেয়ে আলোচিত ছিল তাদের ১৩ দফা দাবি, যেগুলো সরাসরি পূরণ না হলেও পরবর্তীতে সরকার এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলো হেফাজতে ইসলামের দাবির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

পাঠকের মতামত: