কক্সবাজার, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে

উখিয়ায় আগুনের টেকনাফে অপহরণের আতংকে স্থানীয়রা

মোহাম্মদ ইব্রাহিম মোস্তফা, উখিয়া বার্তা ডটকম::

মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর চরম নির্যাতনের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে অনেকে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। হত্যা, মাদক, অস্ত্র ব্যবসা, মানব পাচার, ডাকাতি, চাঁদাবাজির পাশাপাশি স্থানীয়দের অপহরণ ও বসতিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার আতংকে রাত কাটাচ্ছে। এতে করে ক্যাম্পে অপহরণকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে। তবে অপহরণের ঘটনাগুলো উখিয়ার চেয়ে টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে বেশি কিন্তু অন্যদিকে টেকনাফের চেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে ঘটছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও রোহিঙ্গা নেতারা।

২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর সকালে রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের পেঁচারদ্বীপ এলাকা থেকে টেকনাফের সেন্টমার্টিন ভ্রমণের কথা বলে স্থানীয় চার শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে জাহাঙ্গীর আলম ও মোহাম্মদ ইব্রাহীম নামের দুই রোহিঙ্গা। পরে এসব শিক্ষার্থীদের টেকনাফের ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অজ্ঞাত স্থানে জিম্মি করে মোবাইল ফোনে স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ বাবদ ২০ লাখ টাকা দাবি করে আসছিল অপহরণকারী চক্র। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়।

২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল টেকনাফের মিনাবাজার এলাকার স্থানীয় যুবক আকতার উল্লাহকে (২১) ধানক্ষেত থেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। ধারদেনা করে তার বাবা মৌলভি আবুল কাশেম ১ লাখ টাকা পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তবু ছেলের খোঁজ পাননি তিনি। তিন দিন পর উনছিপ্রাং ২২ নং ক্যাম্প থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আকতারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শেষে তার মরদেহ শনাক্ত করেছে তার পরিবার।

জানা যায়, হোয়াইক্যংয়ের ঝিমনখালী মিনাবাজার এলাকার দুই যুবক ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে রাতে পাহাড়ের পাদদেশে ফসল পাহারা দিতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন। পরে তিন দফায় মুক্তিপণ চেয়ে ব্যর্থ হওয়ায় মেরে ফেলা হয় তাদের। ওই সময় তাদের বনের ভেতর দেখে ফেলায় খুন করা হয়েছিল পুটিবনিয়া এলাকার এক চাষিকে।

গত বছরের জুলাইয়ে অপহরণের শিকার হন টেকনাফের শামলাপুর এলাকার সিএনজি অটোরিকশাচালক মাহমুদুল করিম। বাড়ি ফেরার পথে শামলাপুর-হোয়াইক্যং সড়ক থেকে তাকে নিয়ে যান অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ হিসেবে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর অপহরণকারীরা যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। অপহরণের এক মাস পর গত আগস্টে বন বিভাগের লোকজন জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি কঙ্কাল খুঁজে পান। কঙ্কালের পরনের পোশাক দেখে মাহমুদুল করিমকে শনাক্ত করেন তার পরিবারের সদস্যরা।

টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং ২২ নং ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর (ছদ্মনাম) জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রসীরা ক্যাম্পে আটকে রাখার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দিলেও সেগুলো কেটে পথ করেছে তারা। এসব পথ দিয়ে বেরিয়ে বিভিন্ন অপরাধকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ফলে রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আতংকে থাকতে হয়। কারণ যেকোনো সময় অপহরণের ভয় থাকে।

টেকনাফের স্থানীয়রা আরও জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা মিজ্জিরছড়া পাহাড়ে আটকে রাখে। কারণ, শালবন, টইঙ্গার পাহাড়, মিজ্জিরপাহাড়, পানেরছড়াসহ বিশাল পাহাড়ের সঙ্গে টেকনাফের সব পাহাড়ের সংযোগ রয়েছে। তাই এটি সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ।

টেকনাফের রইক্ষ্যং এলাকার স্থানীয় যুবক ইমন বলেন, কিছুদিন আগে গরু নিয়ে পানেরছড়া পাহাড়ে গেলে সেখানে মানুষের দুটি কঙ্কাল দেখতে পান তারা। সেই কঙ্কাল এখনো রয়েছে। এই ক্যাম্পের আশপাশে এ রকম অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যাবে।

অগ্নিকাণ্ড:

অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি৷ যদিও রোহিঙ্গাদের হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷

প্রতিবছর শিবিরগুলোতে ৬০-৫০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও মাইকিং আর মহড়া ছাড়া সংশ্লিষ্টদের খুব বেশি জোড়ালো ভূমিকা চোখে পড়ে না৷ শিবিরে তাৎক্ষণিকভাবে আগুন নেভানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই৷ এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না৷

চলতি বছর ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ এর মধ্য সবশেষ ৯ জানুয়ারি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে গেছে৷ তারমধ্যে স্থানীয়দের ঘর পুড়ে যায় ১৪ টি।

গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার তিনটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় দশ হাজারের বেশি ঘর পুড়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এবং ১১ জনের প্রাণহানি ঘটে। তারমধ্যে স্থানীয়দের ঘর পুড়ে যায় প্রায় শতাধিক।

উখিয়ার স্থানীয় বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন বলেন, শিবিরে বারবার অসাবধানতায় আগুন লাগছে৷ তবে এর পেছনে কোনো নাশকতামূলক তৎপরতা রয়েছে কিনা, সে প্রশ্নও এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে৷ তবে রাত নামলে আতংকে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়।

বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাগোয়া স্থানীয় বাসিন্দা দিল বাহার বলেন, ২০২১ সালে যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আমার সহায়সম্বল হারিয়ে ফেলেছি। শুধু আমার বাচ্চাদের বাঁচাদের বের করতে পারছিলাম। অগ্নিকাণ্ড হতে না হতে রোহিঙ্গাদের তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ৬ মাস খোলা আকাশের নিচে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাতদিন পার করার পরে কিছু সহযোগিতা পেয়েছিলাম।

পালংখালীর রোহিঙ্গাদের কিছু হলে এনজিও, জনপ্রতিনিধি, প্রসাশন এবং মিডিয়াও ব্যস্ত হয়ে যায় কিন্তু আমাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা তাদের নিজের সম্পত্তিতে আশ্রয় দিয়ে কি অপরাধ করেছি? এখন রাত হলে আমাদের ঘর পাহারা দিতে হয়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক বলেন, গেল বছরে উখিয়া শরণার্থী শিবিরে অর্ধশতাধিকের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ক্যাম্পে শীত মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে৷ তাদের গ্যাস সিলিন্ডার ও অসর্তকতার কারণে সামনে এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটার আশঙ্কা রয়েছে৷ এ বছরে এখানে দুইটি আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে৷ তবুও আমরা সবাইকে আরো বেশি সর্তক থাকতে বলেছি৷

রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে এমন অপরাধ প্রবণতা দেশের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি নুর মোহাম্মদ সিকদার।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, একদিকে আগুন অন্যদিকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ দিন দিন বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। তারা পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দিতে না পারলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই হিংস্র কর্মকাণ্ডে আমাদেরও আতংকে থাকতে হয়। তাদের তাণ্ডবে স্থানীয় জনগোষ্ঠী আজ খুবই অসহায়।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ (এপিবিএন) এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন বলেন, এপিবিএনের তৎপরতা, স্থানীয় রোহিঙ্গা ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে পাহারা জোরদার করার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ এখন নিরাপদ। যারা অপরাধে জড়িত ছিল, তারা এরই মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে।

পাঠকের মতামত: