কক্সবাজারের উখিয়ায় উন্মুক্ত কারাগারের জন্য কারা অধিদপ্তরের নামে বন্দোবস্ত হওয়া ১৬০ একর জমির মধ্যে অধিকাংশই অবৈধ দখলে চলে গেছে। ১ নং খাস খতিয়ানের জমি হলেও অসাধু বন বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্থানীয় একটি দখলবাজ চক্র এসব সরকারি খাস জমি ভোগ দখলের পাশাপাশি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।সরেজমিন ওই এলাকায় গেলে এসব তথ্য উঠে আসে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কারা অধিদপ্তরের নামে বন্দোবস্ত হওয়া জমিতে সবচেয়ে বড় দখলদার উত্তর বড় বিল এলাকার মৃত হারু মিয়ার ছেলে মকতুল হোসেন মতু। তিনি একাই দখল করেছেন ১২০ একরের মতো জায়গা। দখলের পর এসব জমি বিক্রি করেছেন চড়া দামে। মহেশখালির উপজেলার সালাউদ্দিন, নুরুল হক, সেলিম ও আমিনকে একশত একর জমি বিক্রি করে। রোহিঙ্গা আমির হামজাকে ৩ একর ও বড়বিল এলাকার বদিউর রহমানের ছেলে নুরুল আলমকে ৫ একর জমি বিক্রি করা হয়। এছাড়া সরেজমিন অনুসন্ধান করতে গিয়ে দখলবাজ মকতুল হোসেন মতু বিভিন্ন সময়ে লোটারি মূল খাস জমি বিক্রির ৫ টি বিক্রয় রশিদ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ওই সব কাগজ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের নতুন পাড়া এলাকার মৃত সোলাইমানের ছেলে সোলতান আহমদ গং কে ৭২ শতক, উখিয়ার রত্নপালং ইউনিয়নের করইবনিয়া এলাকার ছৈয়দ আহমদের স্ত্রী মাবেলা বেগম ও লেঙ্গুরবিল এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মোহাম্মদ নুরকে ৩ একর ২০ শতক, নাইক্ষ্যংছড়ির রেজুর মৌজার বাসিন্দা মো. কালুর ছেলে আবদুল আজিজ গংকে ২ এক ৬ শতক, নাইক্ষ্যংছড়ির সোনাইছড়ি এলাকার নুরুল আলমের স্ত্রী গোলবাহার গংকে ৮ একর ও উত্তর বড়বিল এলাকার নুরুল আলমের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম গংকে ২ একর ৪০ শতক জমি বিক্রি করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় মতু। স্থানীয়দের মতে, উক্ত মতু বিভিন্ন জনের কাছে আরও সরকারি খাস জমি বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মকতুল হোসেন মতুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ভিলেজার হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে ওই জায়গা দখলে আছেন বলে দাবি করেন। ওই জায়গাতে তার আম বাগান, মাছের খামার আছে বলে স্বীকার করেন তিনি। তবে, সরকারের প্রয়োজনে ওই জমি ছেড়ে দিতে প্রস্তুত তিনি। দখল বিক্রির বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, এইসব জমিতে আমবাগান, চারটি মাছের খামার, পানের বরজ, বাড়ি ঘর নির্মান করা হয়েছে। স্থানীয় বনকর্মীদের সহযোগিতায় এইসব দখল ও বেচা-বিক্রি হওয়ায় মকতুল হোসেন মতুর বিরুদ্ধে কোন মামলা বা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো অসাধু বনকর্মীদের সহযোগিতায় সে দখল করেছে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দায়িত্বরত পাগলিরবিল বিট কর্মকর্তা মো. আফসার হোসেন দখলের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমি যোগদানের পূর্বেই এসব জমি দখল হয়েছে। দখলবাজ চক্রের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর না দিয়ে, মামলার রেজিস্টার দেখে বিস্তারিত জানাবেন বলে এডিয়ে যান।
স্থানীয়দের দাবি, উন্মুক্ত কারাগার এর জন্য নির্ধারিত জায়গার বেশিরভাগ অংশই মোটা অংকের বিনিময় স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন বন বিভাগ। এসব উচ্ছেদ করতে গেলে বন কর্মীদের অপকর্মের তথ্য বের হয়ে আসতে পারে এমন ভয়ে কারাগার নির্মাণে বাধা প্রদান করছেন। এ ছাড়াও স্থানীয়দেরকেও কারাগার নির্মাণ রুখে দিতে প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন বন বিভাগ।
সূত্র মতে, উখিয়ায় দেশের প্রথম উম্মুক্ত কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।উপজেলার পাগলির বিল মৌজার ১ নং খাস খতিয়ানভুক্ত বিএস ৮০৩ নং দাগের ৩১০ একর জমি বাংলাদেশের ক্ষুদে অপরাধীদের পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়নের স্বার্থে বন্দোবস্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ প্রেরন করে। প্রয়োজনীয় যাচাই বাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন কারা অধিদপ্তরের নামে ১৬০ একর ভূমি দলিল সম্পাদন করেন। এরপর চলতি বছরের ২৭ মে উখিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও কারাগার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সীমানা নির্ধারণ করে খুঁটি স্থাপন করা হয়। এদিকে ২৫ জুন সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ)’ দারিয়ারদিঘী, কক্সবাজার দক্ষিণতা বন বিভাগ, মো. আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে ওইসব খুঁটি উপড়ে ফেলা হয়। বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষ সংশিষ্ট দপ্তরে বিষয়টি অবগত করলে সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই বন বিভাগের স্থানীয় সহকারী বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সূত্রে মতে, কারা কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ উন্মুক্ত এলাকায় ক্ষুদে অপরাধীদের বৃক্ষরোপন , অর্গানিক ফলমূল ও সবজি চাষ , মৎস চাষ ও পোল্ট্রি ফার্ম ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মালয়েশিয়ার সিআরপির আদলে উক্ত স্থানে উন্মুক্ত কারাগার নির্মানের জন্য সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর ফলে উক্ত এলাকায় ভবিষ্যতে নতুন ভাবে বনায়ন সৃষ্টিসহ ব্যাপকভাবে মৎস চাষ , পশু ও হাঁস মুরগী পালনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং প্রাকৃতিকভাবেও বিভিন্ন প্রানীর বসবাসের অভয়ারণ্য হবে বলে সকলে মনে করেন । সংগত কারনেই এ ক্ষেত্রে বন ও পরিবেশের ক্ষতির কোন আশংকা নাই বরং তা বন ও পরিবেশের উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে কারা কর্তৃপক্ষ মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সারওয়ার আলমের দৃষ্টি আকর্ষন করা হলে তিনি কারাগারের বরাদ্দকৃত জায়গাতে অবৈধ স্থাপনার কথা স্বীকার করে বলেন, অবৈধ দখলবাজদের উচ্ছেদ এর জন্য জেলা প্রশাসনকে আবেদন করা হবে। তবে তিনি তাঁর কর্মকালীন সময়ে দখল হয়নি বলে দাবি করেন।
পাঠকের মতামত: