কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বখতিয়ার মেম্বার নিহতের পর আত্মগোপনে গডফাদাররা

উখিয়া-টেকনাফে ইয়াবায় সাধারণ অবস্থা থেকে কোটিপতি জনপ্রতিনিধি

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের অনেক জনপ্রতিনিধি ইয়াবা কারবারি অথবা গডফাদার হিসাবে পরিচিত। মাদক কারবারের মাধ্যমে রাতারাতি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে ওঠা এসব জনপ্রতিনিধির কেউ কেউ টাকা দিয়ে দলীয় পদ-পদবী কিনে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চালান রাজত্ব। কিন্তু সরকারের সাম্প্রতিক মাদক বিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে একে একে পতন ঘটে চলেছে ইয়াবা কারবারিদের সাম্রাজ্য। শুক্রবার টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত উখিয়ার বখতিয়ার মেম্বার এর সর্বশেষ উদাহরণ।

এ নিয়ে গত দুই বছরে মাদক বিরোধী অভিযানে অর্ধ ডজন জনপ্রতিনিধি নিহত ও আরো প্রায় দুই ডজন জনপ্রতিনিধি আত্মসমর্পণ করে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। অভিযানে নিহত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নং কুতুপালং ওয়ার্ডের মেম্বার বখতিয়ার আহমদকে উখিয়া উপজেলার শীর্ষ স্থানীয় গডফাদার বলে মনে করা হতো। রোহিঙ্গাদের পুঁজি করে গত ২৯ বছরে টং দোকানের চা বিক্রেতা থেকে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া বখতিয়ার মেম্বার কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র। কুতুপালং ও পার্শ্ববর্তী বালুখালী এলাকা মিলে এখন চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বাস। কুতুপালংয়ের মতো বালুখালীতেও রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের উৎপাত। প্রায় ৩ বছর আগে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকে শান্তশিষ্ট বালুখালী গ্রামটি সন্ত্রাসী ও মাদকের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে। এ গ্রামের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও রয়েছে ইয়াবা ও জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ। ইতোমধ্যে অর্ধলক্ষ ইয়াবা নিয়ে এ গ্রামের এক মেম্বার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে কারাগারে রয়েছেন। কয়েক দিন আগে ১০ হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছেন ওই গ্রামের আরেক মেম্বার ও উখিয়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক নুরুল আবছার চৌধুরী। এর আগে একই ইউনিয়নের জয়নাল মেম্বারও বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন।
এলাকাবাসীর মতে, কুতুপালংয়ের শীর্ষ গডফাদার ছিলেন বখতিয়ার মেম্বার।
আর বালুখালীর হলেন আবছার মেম্বার। কয়েক দিন আগে নিজ বাড়ির সামনে ইয়াবা লেনদেন করার সময় আবছার মেম্বারকে তার সহযোগী, কমিউনিটি পুলিশিং উখিয়ার অর্থ সম্পাদক ও কৃষকলীগ নেতা নুরুল আলম চৌধুরীসহ গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযানে তাদের কাছ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা ছাড়াও একটি অলিখিত ব্যাংক চেক, স্বাক্ষরকৃত ছয় লক্ষ টাকার অপর একটি ব্যাংক চেক, ৩টি এটিএম কার্ড ও স্বাক্ষরকৃত ২টি অলিখিত স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) আবদুল্লাহ মোহাম্মদ শেখ সাদী বলেন, আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে মেম্বার নুরুল আবছার চৌধুরী স্বীকার করেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইয়াবা ট্যাবলেট সংগ্রহ করে কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাচার করে আসছেন। তাদের একটি বিশাল সিন্ডিকেটও রয়েছে। নুরুল আবছার চৌধুরী পালংখালী ইউনিয়নের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৃত নজির আহমদ চৌধুরীর ছেলে।
এলাকাবাসী জানায়, আবছার মেম্বারকে আটক করার পর তার সহযোগী নুরুল হক, আশিক, রোহিঙ্গা কবির আহমেদ প্রকাশ কবির মাঝি, রোহিঙ্গা লালু মাঝি, রোহিঙ্গা চিকুইন্না, রোহিঙ্গা জামাল ও রোহিঙ্গা ডাক্তার ওসমান আত্মগোপন করেছেন। তবে আবছার মেম্বার গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার ভাগিনা আলমগীর নিসাই সিন্ডিকেটের বর্তমান হাল ধরেছে বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
এলাকাবাসীর সূত্র মতে, ২০১৩ সালে জালিয়াপালং ইউনিয়নের নিদানিয়ায় অবস্থিত ‘সী কিং’ হ্যাচারিতে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন নুরুল আবছার চৌধুরী। এরপর চাকরি ছেড়ে ইয়াবা জগতে পা বাড়ান। কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে তুলেন প্রায় শত কোটি টাকার সম্পদ। ইয়াবা বিক্রির কালো টাকা বিলিয়ে ২০১৬ সালে মেম্বার নির্বাচিত হওয়া নুরুল আবছার চৌধুরীর বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগও রয়েছে। তিনি বালুখালীতে সরকারি খাস জায়গা দখল করে দুটি তিনতলা ভবন নির্মাণ করেন। বালুখালী ও কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে কোটি টাকার জমি কিনে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেন। এছাড়া বহু গাড়ির মালিকও বনে যান। আর টাকা উড়িয়ে বাগিয়ে নেন উখিয়া উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদকের পদ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন উখিয়া উপজেলার শাখার সভাপতির পদ।
এদিকে আবছারের ইয়াবা ব্যবসা ও অবৈধ উপার্জন নিয়ে পিলে চমকানোর মতো তথ্য দেয় এলাকাবাসী। ২০১৬ সালের ১৮ জুন পালংখালী ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য পদে নির্বাচন করার জন্য নুরুল আবছার বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের কাছে যে হলফনামা জমা দেন, ওখানে তার নগদ মাত্র ১৫ হাজার টাকা ও ব্যাংকে ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা থাকার তথ্য দেয়া হয়। হলফনামায় যে অর্থ উল্লেখ করেছিলেন তিনি, সেটি মাত্র চার বছরে বহু গুণ বেড়ে গেছে। অথচ দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা উল্লেখ ছিল না হলফনামায়। হলফনামায় তিনি আয়ের খাত হিসেবে ২ কানি কৃষি জমি ও কৃষি খাত থেকে তার আয় মাত্র ৩০ হাজার টাকা, ব্যবসা থেকে আয় ১ লাখ ১০ হাজার টাকা উল্লেখ করা হলেও সেটি কী ব্যবসা তা উল্লেখ করেননি। বাড়ি, গাড়িসহ আরো বহু সম্পদের কথাও উল্লেখ করেননি।
২০১৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত মাত্র ৪ বছরে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন এসেছে আবছারের অর্থ-সম্পদে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা আসার পর থেকে। হলফনামায় বাড়ির কথা উল্লেখ না থাকলেও বর্তমানে আবছার দুটি তিনতলা বিশিষ্ট ভবন এবং ১টি বিশাল টিনশেড কলোনির মালিক। এছাড়া বালুখালী পানবাজারে আবছারের বিশাল মুদির দোকান আছে। আছে একটি নোয়া মাইক্রোবাস, একটি ডাম্পার ও একটি ট্রাক। ইয়াবা বহনের জন্য কক্সবাজার-চট্টগ্রাম-ঢাকা মহাসড়কে এসব যানবাহনকে ব্যবহার করেন তিনি। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া নুরুল আলম চৌধুরীও ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্য। তার সহোদর নুরুল আমিন চৌধুরী ইতঃপূর্বে ইয়াবার চালান নিয়ে ধরা পড়ে বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, তলে তলে ইয়াবা কারবারি ও মুখে বড় কথা বলা জনপ্রতিনিধিসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে তা থেকে কেউই রেহাই পাবে না। মাদক কারবারিদের একে একে চিহ্নিত করে আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যেই কক্সবাজার জেলাকে মাদক মুক্ত করা হবে। আজাদী

পাঠকের মতামত: