কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

এতো জুলুম আল্লায় সইবো না’

news

এতো জুলুম আল্লায় সইবো না। আল্লাহ এইগুলো চোখে দেহে না। আল্লাহ গরীব মাইনষেরে বাঁচাই রাখে। কি লাইগ্যা আমরা ঘরডা ভাঙল? এহন কোথায় থাকমু?’

কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকার আহম্মদ হাওলাদারে ছেলে সিরাজ হাওলাদার। বছর পাঁচেক আগে নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয় পরিবারটি। পরিবার নিয়ে ঘর তুলেছিল কুতুবপুর গ্রামে। সেই মাথা গোজার ঠাঁই হারিয়ে আবার নিঃস্ব পরিবারটি। বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে ভেঙে ফেলা হয়েছে তার বসত ভিটা।

ষাটোর্ধ্ব কৃষক মো. শাহ্ আলম মৃধা। পাঁচ বছর আগে ১০ শতাংশ জমিতে দুই ভাই মিলে দুটি ঘর আর কিছু গাছপালা লাগান। নিজের ফসলি জমি নেই, তাই অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করেই চলে তাঁর সংসার। হঠাৎ তার এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি।

শাহ্ আলম মৃধা বলেন, ‘আমাগো মাগুরখণ্ড ইউনিয়নে হাজরা এলাকায় বাড়ি ছিল। পদ্মা সব ভাইঙা লইয়া গেলে কুতুবপুরে জমি কিইনা দুই ভাই বাড়ি করছি। কিছু গাছ-গাছালি লাগাইছি। চেয়ারম্যানের লোকজন আইয়া হঠাৎ কইরা এগুলো ভাইঙা নিতে কইছে। সাতকুলে আর তো থাকোনের জায়গা নাই। বাড়িঘর ভাইঙা নিয়ে আমরা কোথায় ঠুঁই লমু? দুই মাইয়া, বৌ লইয়া পথেপথে থাকোন ছাড়া আর কোন উপায় নাই।’

পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেস হাইওয়ের পাশে আইসিটি মন্ত্রণালয় শিবচর উপজেলার কুতুবপুর ও কাঠালবাড়ি ইউনিয়নের প্রায় ৭০ দশমিক ৩৪ একর জমি নিয়ে হাইটেক পার্ক নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। সম্প্রতি আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমি হুকুম দখলের প্রস্তাব করে। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকায় কিছু অবৈধ ঘরবাড়ি, বাগান ও খামার স্থাপন করে এক শ্রেণির দালাল চক্র।

এই পরিস্থিতিতে গত ১৮ জানুয়ারি ওই এলাকায় সম্ভাব্য ক্ষতিপ্রস্তদের নিয়ে সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। সভায় জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন এক সপ্তাহের মধ্যে সকল স্থাপনা ভেঙে ফেলার নির্দেশনা দেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানদের। পরে গত বুধবার থেকে কাঁঠালাবাড়ি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল বেপারী ও কুতুবপুর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর মাতুব্বর নেতৃত্বে এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়।

একই সঙ্গে বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মিরাজ হোসেনের নেতৃত্বে একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট ও বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনীর সদস্য প্রকল্প এলাকায় অভিযান শুরু করে। এ পর্যন্ত শতাধিক ঘরবাড়ি ও স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে প্রশাসন। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা।

এদিকে প্রকল্পটি নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে ক্ষতিপূরণ ছাড়াই স্থাপনা ও গাছপালা উচ্ছেদের প্রতিকার চেয়ে বুধবার বিকেলে শিবচরের কুতুবপুর ইউনিয়নের বড় কেশবপুর এলাকায় মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা। মানববন্ধনে প্রায় তিন শতাধিক ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ অংশ নেন।

এ সময় তারা জানায়, প্রথমে ৪ ধারা নোটিশ দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থদের কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ ও নোটিশ না দিয়েই গত ১৮ জানুয়ারি এক সপ্তাহের মধ্যে স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অনিয়ম। প্রশাসন তাদের ক্ষমতা বলে ইচ্ছেখুশি মত কাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের কথা প্রশাসন কিছুই শুনছে না। তবে প্রশাসন পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকল্প এলাকায় নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নিয়ম মেনেই উচ্ছেদ চালানো হচ্ছে।’

বৃহস্পতিবার সরেজমিনে প্রকল্পটির নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে গিয়ে দেখা যায়, মাটি কাটা যন্ত্র দিয়ে নতুন-পুরানো সব ধরণের স্থাপনা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। দুটি ইউনিয়নের কোথাও প্রশাসন আবার কোথাও ইউপি চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে হচ্ছে এ উচ্ছেদ অভিযান। গড়ে উচ্ছেদ চলায় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা ক্ষতিপূরণ না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কেশবপুর এলাকার সিরাজ মুনশি বলেন, ‘আমার থাকনের ঘর বাদে গরুর ঘর, খামাম সব ভাইঙা দিছে। আমি ক্ষতিপূরণ পাইলাম নাই। নোটিশও পাইলাম নাই। হঠাৎ তারা আমার এমন ক্ষতি কইরা কী পাইলো?’

স্থানীয় সাইদুর ব্যাপারী নামে একজন জানান, হাতে গোনা কিছু অসাধু লোক অতিরিক্ত বিল নিতে নতুন নতুন ঘর বাড়ি তুলেছে। যা দেখলেই বোঝা যায়। প্রশাসন থেকে যাচাই-বাছাই করে উচ্ছেদ চালানো উচিৎ ছিল। আমরা চাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা যাতে ক্ষতিপূরণ পায়।

এ সম্পর্কে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ প্রকল্পটি এখানে হওয়ার খবরে দালাল চক্র সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের জন্য অসংখ্য স্থাপনা ও বাগান করে। এ স্থাপনাগুলো দিয়ে দালালচক্র পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে টাকাও উত্তোলন করে। আমরা এ স্থাপনাগুলো সরিয়ে নিতে ৭ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। ১০ দিনের মাথায় এসে অবৈধ স্থাপনাগুলো অপসারণ শুরু করেছি। অনেকে নিজে থেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিয়েছে অনেকেই আবার নেয়নি। আমাদের এই অভিযান চলামান থাকবে।’

জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক রহিমা খাতুন বলেন, ‘৪ ধারা নোটিশ প্রদান করার পরে আমরা দেখলাম কিছু নতুন ঘর ও স্থাপনা করা হয়েছে। আমরা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কাজ শুরু করেছি। তবে, পুরানো ঘরবাড়ি ও গাছপালা উচ্ছেদ করা হবে না। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এ বিষয় আমাদের নজর আছে।’

পাঠকের মতামত: