কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

নগদ টাকা সংকটে ব্যাংকগুলো

রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের একটিও নিজপায়ে দাঁড়াতে পারছে না। এরমধ্যে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জনতা ব্যাংক আছে নাজুক পরিস্থিতিতে। একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে সোনালী, অগ্রণী রূপালী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএলেও। এছাড়া, বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও এই সংকট ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর জন্য বেশ কিছু ব্যাংককে ধার করে ও মূলধন ভেঙে চলতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা করে ধার নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। গত একসপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত রবিবার (২৬ মে) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ব্যাংকগুলো ধার নিয়েছে ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। এরপর সোমবার ৬ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা, মঙ্গলবার ৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা, বুধবার ৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা এবং বৃহস্পতিবার ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার নেয়।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকও রেপোর বিপরীতে প্রায় প্রতিদিনই ধার দিচ্ছে। গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংক তিনটি ব্যাংককে রেপো ও তারল্য সহায়তা হিসেবে ২৮৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ধার দেয়। আগের দিন মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছিল ১৯৯ কোটি টাকা। গত ২২ মে ধার দিয়েছিল এক হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। গত ২০ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছিল এক হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বিরাজ করছে। চাহিদা অনুযায়ী আমানত না আসায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৩০টিরও বেশি ব্যাংক এখন ধার করে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআরআর (নগদ জমা) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ সঞ্চিতির হার) জমা রাখতে পারছে না। ডজনখানেক ব্যাংক তাদের মূলধনও ভেঙে খাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতের নিট বা প্রকৃত মুনাফা অর্ধেকে নেমেছে। ২০১৮ সালে ব্যাংকগুলোর নিট মুনাফা হয়েছে মাত্র চার হাজার ৪০ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে যা ৫৭ শতাংশ কম। ২০১৭ সালে নিট মুনাফা ছিল ৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পদ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলোর অদক্ষতার ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর ফলে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে মুনাফা কমেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, বড় গ্রাহকদের অনেকেই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করেও কিস্তি পরিশোধ করেন না। ফলে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে খেলাপি ঋণের বিপরীতে আয় থেকে বিপুল অর্থ সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে। এতে নিট মুনাফা কমে গেছে।

এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘২০১৮ সালজুড়েই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ছিল। যার ফলে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া গত বছরে খেলাপি ঋণও বেড়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। এসব কারণে নিট মুনাফা কমে গেছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে সোনালী ব্যাংক নিট মুনাফা করেছিল ৭০৯ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে এটি কমে ২২৬ কোটি টাকায় নেমেছে। জনতা ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ২৬৮ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে কমে হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৬৭৬ কোটি টাকা। গত বছর তা কমে ১০৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ৫০ কোটি টাকা থেকে ৩৮ কোটি টাকায় নেমেছে ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। এর বাইরে খেলাপি রয়েছে আরও প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো প্রয়োজনে কলমানি থেকে ধার করতেই পারে, তবে বর্তমানে ব্যাংক খাতে পরিস্থিতি বেশি ভালো বলার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এই খাতে যতদিন সুশাসন না আসবে, ততদিন পর্যন্ত খেলাপি বাড়তেই থাকবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ঋণের টাকা ফেরত না আসা ও আমানতের চেয়ে ঋণ বিতরণ বেড়ে যাওয়া কারণে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চে যেখানে ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৭৬ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের মার্চে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৬৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৩ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭৭ হাজার ১২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে আমানত বেড়েছে ৪৬ হাজার ৪৬ কোটি টাকা। অবশ্য একবছরে আমানত বেড়েছে ৯৭ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চ শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা।

২০১৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ৮১ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৯ লাখ ১৭ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ছয় মাসে ঋণ বেড়েছে ৬৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। আর এক বছরে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ২০১৮ সালের মার্চ শেষে ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।

পাঠকের মতামত: