কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

পাঁচ বছর পর ফের রক্ত ঝরলো বাঁশখালীর গণ্ডামারায়

পাঁচ বছর পর আবার রক্ত ঝরলো চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পক্ষে-বিপক্ষের লোকজন ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে দুই ভাইসহ চারজন নিহত হয়েছিল। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিল ১১ পুলিশসহ অন্তত ১৯ জন। এবারও এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক মারা গেল।

শনিবার বেলা ১১টার দিকে শ্রমিকরা তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বাধে। এতে পুলিশের গুলিতে পাঁচ শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয়েছে ২৩ শ্রমিক। আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় গুলিবিদ্ধ আহত ১১ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জানা যায়, বকেয়া বেতন পরিশোধ, বেতন বৃদ্ধির দাবি, শুক্রবার একবেলা কাজ করা ও ইফতারের জন্য সময় বরাদ্দসহ ১০ দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে শ্রমিকরা। এ সময় পুলিশের সাথে সংঘর্ষ হলে এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই চারজন শ্রমিক নিহত হয়।

নিহতরা হলেন- গণ্ডামারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব বড়ঘোনা মো. আবু ছিদ্দিকের ছেলে আহমেদ রেজা (১৮), একই এলাকার অলি উল্লাহর ছেলে রনি হোসেন (২২), নূর জামানের ছেলে শুভ (২৪) ও মো. দালু মিয়ার ছেলে মো. রাহাত (২২)। প্রথম ৪ জনকে বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরে দুপুরের দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রায়হান নামে একজন মারা যান।

এদিকে, শ্রমিকদের নিহতের খবরে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া আশেপাশের অন্তত ১০ হাজারের বেশি মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ঘেরাও করে রেখেছে। এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় গুলিবিদ্ধ আহত ১১ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতরা হলেন- হাবিব উল্লাহ (২১), মো. রাহাত (৩০), মিজান (২২), মো. মুরাদ (২৫), মো. শাকিল (২৩), মো. কামরুল (২৬), মাসুম আহমদ (২৪), আমিনুল হক (২৫), মো. দিদার (২৩), ওমর (২০) ও অভি (২২) এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও এ ঘটনায় গণ্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির তিন সদস্য আহত হয়েছেন। তারা হলেন- ইয়াসির (২৪), আব্দুল কবির, (২৬) ও আসাদুজ্জামান (২৩)।

অন্যদিকে, ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল চারজন। তারা হলেন- গণ্ডামারা ইউনিয়নের চরপাড়ার আশরাফ আলী বাড়ির দুই ভাই মরতুজা আলী (৫৫) ও আনোয়ারুল ইসলাম (৪৪), একই ইউনিয়নের রহমানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার পূর্বপাশের বাওত্তার বাড়ির জাকের আহমদ (৬০)। এই তিনজন ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মো. জাকির হোসেন নামের একজন মারা যান।

মূলত সেই সময়ে কয়লাভিত্তিক বেসরকারি ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি নেয়াকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। তবে একটি অংশ ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে অবস্থান নিলে দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতাকারীরা ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল (সোমবার) বিকেলে ‘বসতভিটা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশের ডাক দিলে অন্য পক্ষও পাল্টা সমাবেশ ডাকে। উত্তেজনা এড়াতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল।

এলাকাবাসী ১৪৪ ধারা ভেঙে সমাবেশ করতে গেলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরিবেশবাদীরা স্বোচ্চার হয়ে ওঠে।

সেই এস আলমের মালিকানাধীন এই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ এগিয়ে চললেও পাঁচ বছর পর আবারও রক্ত ঝরলো। এবার সেখানে দাবি আদায়ে নিহত হলো পাঁচ শ্রমিক।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকরা জানায়, চীন এবং এস আলম গ্রুপের যৌথভাবে গণ্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কর্মরত শ্রমিকরা ১০ দফা দাবি পেশ করে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- রমজানে দুপুরের বিরতি বাদ দিয়ে টানা দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি, শুক্রবারে জুমার দিন আধা বেলা হাজিরায় পুরো বেতন, বিনা নোটিশে ছাঁটাই বন্ধ, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবস্থ্যা।

এসব দাবি আদায়ের জন্য গত তিনদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে শ্রমিকেরা। এসব দাবি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের দাবিকে অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করে। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে বাকবির্তক হয়। এক পর্যায়ে উত্তেজিত শ্রমিকরা বিদ্যুৎ ও পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালায়।

বাঁশখালী থানার ওসি (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভেতর বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আগুন ধরিয়ে দেন। সংঘর্ষে ৫ জন নিহত হওয়ার খবর পেয়েছি। এ সময় অন্তত ২৫ জন আহত হয়। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. জহিরুল হক বলেন, বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ৬ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন জানান, বাঁশখালী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিকদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। ওই সংঘর্ষে পাঁচ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার লিমিটেড ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে ২৫০ কোটি ডলার ব্যয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে চুক্তি সই অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গণ্ডামারা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমি কেনা হয়েছে।

এই প্রকল্পের ৭০ শতাংশের মালিকানা থাকবে এস আলম গ্রুপের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের মধ্যে সেপকো ২০ শতাংশ এবং চীনের অপর প্রতিষ্ঠান এইচটিজি ১০ শতাংশের মালিক হবে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর কেন্দ্রটিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনও উৎপাদনে যেতে পারেনি তারা।

পাঠকের মতামত: