কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪

বজ্রপাতে বেশি মারা যায় কৃষক-জেলে

বজ্রপাত মানে কয়েক লাখ ভোল্টের একটি কারেন্ট। বজ্রপাত আবহাওয়ার একটি সাধারণ ঘটনা হলেও সম্প্রতি এতে বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। গত ১০ বছরে দেশে প্রায় ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জাতীয় দুর্যোগের তালিকায় ২০১৬ সালের ১৭ মে বজ্রপাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

গবেষণা বলছে কিশোরগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, লালমনিরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় বজ্রপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর শিকার কৃষকসহ খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। সর্বশেষ গত ১৯ মে বজ্রপাতে একদিনে ১০ জেলায় ২২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার যে দেশগুলোয় বজ্রপাতের প্রবণতা বেশি, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও আগাম বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে তালগাছের চারা রোপণ ছাড়া তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তা দিতে ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকার দেশের ৮টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসালেও তা দিয়ে এখনো মিলছে না সতর্কবার্তা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২৫ মিলিয়ন বজ্রপাত হয়। কিন্তু দেশটিতে মানুষ মারা যায় ৪০ থেকে ৫০ জন। ভারতীয় আবহাওয়া অফিসের রাডার থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২ হাজার ৪০০-এর মতো বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিবছর কতগুলো বজ্রপাত হয় সেটি রেকর্ড করার প্রযুক্তি দেশে নেই।

দেশের বজ্রপাত নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ ফারুখ। তিনি বৃহস্পতিবার আমাদের সময়কে বলেছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান। একদিকে বঙ্গোপসাগর, এর পরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর আর্দ্র বাতাস আসছে। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা, কিছু দূরেই হিমালয়, যেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে। এ দুটি বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।

তিনি বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বজ্রাঘাতের একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে ভেনিজুয়েলা এবং ব্রাজিলে। কিন্তু সেখানকার তুলনায় দেশের আয়তন হিসাবে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। এর কারণ হিসাবে তিনি সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন। এর বেশি শিকার হন খোলা মাঠে কাজ করা কৃষক বা জেলেরা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে খোলা জায়গায় মানুষজন কাজ করার কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলার কারণেও হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে জানান তিনি। কৃষক ও জেলেরাই বজ্রাঘাতের বেশি শিকার হচ্ছেন দাবি করে ড. ফারুখ বলেন, ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সতর্ক করা গেলে বজ্রাঘাতে মৃত্যুর হার কমে আসবে। এ জন্য তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান।

এদিকে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকাতে দেশবাসীকে ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে সতর্কবার্তা দিতে দেশের ৮টি স্থানে পরীক্ষামূলক বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও ময়মনসিংহ, সিলেট, পঞ্চগড়, নওগাঁ, খুলনা পটুয়াখালী এবং চট্টগ্রামে এই সেন্সর বসানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আটটি ডিটেকটিভ সেন্সরের যন্ত্রপাতি কেনায় খরচ হয়েছে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। তবে এ যন্ত্র থেকে এখনো সতর্কবার্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ আমাদের সময়কে বলেন, এটি এখনো পর্যবেক্ষণে আছে। এখান থেকে তথ্য পেতে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ড. ফারুখ বলেছেন, আমরা যতটুকু জেনেছি, এ মেশিন অপারেট করার মতো দক্ষ লোকবল নেই। এ কারণে এটি থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।

ওদিকে বজ্রপাত থেকে প্রান্তিক জনগণকে বাঁচাতে তালগাছ লাগানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশের ৬১ জেলায় এখন পর্যন্ত ৫৪ লাখ ১১৯টি তালের আঁটি লাগানো হয়েছে। তবে এটিও কোনো তাৎক্ষণিক সমাধানে আসবে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বজ্রপাতের ঝুঁঁকি হ্রাসের উপযোগী হতে এ গাছের কমপক্ষে ২০-২৫ বছর বা তারও বেশি সময় প্রয়োজন। তালগাছ লাগিয়ে সেটি বড় করে তোলা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় একে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য সুপারিগাছ লাগানোয় জোর দেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তালগাছের তুলনায় সুপারিগাছ দ্রুত বর্ধনশীল, প্রায় ৫০-৬০ ফুট উঁচু হয় এবং তালগাছের প্রতি ৩০ ফুটের মধ্যবর্তী স্থানে রোপণ করা যায়। তবে সুপারি গাছ লাগানো কোনো কার্যক্রমে এখনো দেখা মেলেনি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএ ফারুখের গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডাব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্কফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা বলছে, প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়ে থাকে।

অধ্যাপক ড. এমএ ফারুখ জানান, বছরের যে কোনো সময়ের চেয়ে মে মাসেই বজ্রাঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে বজ্রাঘাতে মোট এক হাজার ৯৮৬ প্রাণহানির মধ্যে ৩২ শতাংশই ঘটেছে মে মাসে। এপ্রিলের শেষভাগ থেকে শুরু হয়ে মে মাসের তৃতীয়ার্ধ নাগাদ বাংলাদেশের বায়ুম-লের প্রায় ৫-৬ হাজার মিটার ওপরে আর্দ্র ও উষ্ণ বাতাস অবস্থান করে। এ কারণে মে মাসে অধিক বজ্রঝড় হয়ে থাকে। তবে এ বছর জুন-জুলাই মাসে বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়বে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন তিনি।

যুক্তি হিসেবে তিনি জানান, শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস আসতে শুরু করে, অন্যদিকে হিমালয় থেকে আসে ঠা-া বাতাস। দক্ষিণের গরম আর উত্তরের ঠা-া বাতাসে অস্থিতিশীল বাতাস তৈরি হয় আর এর থেকে তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এ বছর শীতের পর বঙ্গোপসাগর থেকে উষ্ণ বাতাস এক মাস পর এসেছে। ফলে এ বছর বৈশাখে তেমন ঝড়-বৃষ্টির দেখা মেলেনি। এ পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতের সময়টাও পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা স্থায়ী পরিবর্তন নয় বলেও জানান তিনি।

বজ্রপাতে সম্প্রতি বছরগুলোয় কেন বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় দেশের বেশিরভাগ গ্রাম এলাকায় তাল, নারিকেল, বটসহ নানা ধরনের বড় গাছ ছিল। এসব বড় গাছ বজ্রপাতের আঘাত নিজের শরীরে নিয়ে নিত। ফলে মানুষের আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা কমত। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ এলাকাতেই তাল, নারিকেলসহ বড় বড় গাছ কেটে তৈরি করা হচ্ছে শিল্প কলকারখানা। হচ্ছে ঘরবাড়ি, নগরায়ণ। তা ছাড়া সংরক্ষিত বনভূমিও কেটে সাবাড় করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বজ্রপাতের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছেই।

বজ্রপাতবিষয়ক গবেষকরা বলছেন, এ ছাড়া দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখন মুঠোফোন থাকছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় মুঠোফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ার রয়েছে। দেশের কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। আকাশে সৃষ্টি হওয়া বজ্র মাটিতে কোনো ধাতব বস্তু পেলে তার দিকে আকর্ষিত হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বজ্রপাত মোকাবিলায় বড় গাছ, বন হলো আমাদের ন্যাচারাল প্রোটেকশন। বন উজাড় করে গাছ লাগালে হবে না। গাছ লাগানোর আগে কাটা বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বজ্রপাতের কারণ চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি এটি মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্য অনুসারে, বজ্রাঘাতে ২০১০ সালে মারা গেছে ১২৩ জন, ২০১১ সালে ১৭৯, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৬ সালে ৩৫০, ২০১৭ সালে ৩০২, ২০১৮ সালে ২৭৭, ২০১৯ সালে ২৩০ ও ২০২০ সালে ৩৮০ জন মারা গেছেন। চলতি বছরের ১ মে পর্যন্ত মারা গেছেন ৮৮ জন ।

যেসব জেলায় বেশি বজ্রপাত হয়

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএ ফারুখের নেতৃত্বে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে।

জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম ব্যবহার করে দেখা গেছে রংপুর বিভাগের মধ্যে ঠাকুরগাঁও এবং লালমনিরহাটে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয়। রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ময়মনসিংহ বিভাগে বেশি বজ্রপাত হয় নেত্রকোনায়। ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জে ও সুনামগঞ্জে বজ্রপাত বেশি হলেও মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি উত্তরাঞ্চলে।

তিনি বলেন, দুটো বিষয়- একটা জায়গায় বজ্রপাত বেশি হচ্ছে, কিন্তু মারা যাচ্ছে কম। আবার অন্য জায়গায় বজ্রপাত কম হলেও মানুষ মারা যাচ্ছে বেশি। অধ্যাপক ফারুখ জানান, এ গবেষণার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৮ বছরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ২০১৮ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি মৃত্যু হয়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ ও সাতক্ষীরায়। এর পরই সিলেট ও হবিগঞ্জ। এ ছাড়া রংপুর, গাইবান্ধা, রাজশাহীতে মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটেছে।

পাঠকের মতামত: