কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

বারবার কেন আগুন রোহিঙ্গা শিবিরে?

আবদুর রহমান, টেকনাফ::

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি।

রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, শরণার্থী শিবিরগুলোতে বারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও তা প্রতিরোধে শক্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শিবিরে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর শিবিরে ৫০-৬০টি মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করার মতো ‘প্রযুক্তি’ তাদের হাতে নেই। তবে আগের চেয়ে অগ্নিকাণ্ড কমেছে।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় চারটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে সোমবার (১৭ জানুয়ারি) উখিয়ার ইরানি পাহাড়ের ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ২৯টি ঘর পুড়ে গেছে।

এর আগে ৯ জানুয়ারি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যায়। কিন্তু টেকনাফের চেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। দেশে সেই প্রযুক্তিও নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষয়ক্ষতি ও ঘটনাস্থল বিশ্লেষণ করে ঘটনার কারণ অনুমান করা হয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ক্যাম্পে শীত মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সবাইকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে আগের তুলনায় শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা কমেছে।

সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে, শিবিরে বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে। তবে এটা সত্য, কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ঘটছে। কর্তৃপক্ষের উচিত ক্যাম্পে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক নেভানোর ব্যবস্থা রাখা। এ ছাড়া আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দরকার। তাছাড়া আগুনের ঘটনা থামবে না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টেকনাফ স্টেশনের কর্মকর্তা মুকুল কুমার নাথ জানান, বেশিরভাগ শিবির পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি ঝুপড়িঘর ও ঘনবসতির কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের কর্মী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু খারাপ লোক রয়েছে, যারা আগুন লাগার ঘটনায় জড়িত। তারা চায় এখানে সবসময় অশান্তি থাকুক। তাছাড়া কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অবহেলার কারণেও ঘটে থাকে। ফলে শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানায়, শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা উদ্বেগনজনক হারে বাড়ছে। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ৮৪ বার আগুন লাগে, যা আগের বছরের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। এতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, গৃহহীন হয়েছেন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।

এইচআরডব্লিউ বলছে, এসব ঘটনায় রোহিঙ্গাদের অবহেলার কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ নাশকতার কথাও বলছেন। তবে, বাস্তবে কী ঘটছে সেটা জানা যাচ্ছে না। কারণ, আগুন লাগার ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না।

অগ্নিকাণ্ড কি পরিকল্পিত?

উখিয়ার বালুখালীর একটি শিবিরে ২০২১ সালের ২২ মার্চ আগুন লেগে শিশুসহ ১১ জনের মৃত্যু হয়। আশ্রয় হারায় প্রায় ৪৫ হাজার শরণার্থী। তবে সেই সময় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর মৃতের সংখ্যা ১৫ জন উল্লেখ করেছিল। এরপর আগুন লাগার ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ বলে অভিযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন বলেন, আগুন লাগার কারণ চিহ্নিত করার প্রযুক্তি আছে কিনা জানা নেই। তবে শরণার্থী শিবিরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড রোধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শফিউল্লাহ কাটা শিবিরে আগুন লাগার ঘটনায় প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

সুপারিশ বাস্তবায়ন চায় রোহিঙ্গারা  

২০২১ সালের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালী-৮ ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডে ১০ হাজার ১৬৫টি বসতঘর পুড়ে যায়। এতে প্রাণ হারান ১১ জন। ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদন দাখিল করে। এতে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি ও জানমাল রক্ষায় ১৩ দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রোহিঙ্গা নেতাদের।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বাস্তবায়ন হলে অগ্নিকাণ্ড রোধ হবে বলে মনে করেন কক্সবাজার শিবিরে রোহিঙ্গা ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা কিন মং।

তিনি বলেন, শিবিরে বারবার আগুন লাগার কারণে মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শিবিরে অগ্নিনির্বাপণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রসহ পানির ব্যবস্থা না থাকায় বারবার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে শত শত ঘর।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনীর বলেন, শিবিরে আগুন লাগার কারণ বের করা না গেলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা অসম্ভব। সবার সমন্বিত তদন্তে কোনটি অগ্নিকাণ্ড আর কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা, তা বের করা দরকার। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাবে না। শিবিরে আগুন লাগার পেছনে ‘নাশকতা’র অভিযোগ পুরনো।

পাঠকের মতামত: