কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

‘ভাসানচর না যেতে হুমকি’

আবদুর রহমান, টেকনাফ::

‘তুই কে? ভাসানচরে নিয়ে যাওয়াদের সরকারের কাছে তালিকা দেবার দায়িত্ব তোকে কে দিয়েছে? খবর আছে তর, এই দুনিয়ায় বেশি দিন ঠাঁই হবে না। আবার কথা হবে।

(৯ সেপ্টেম্বর) বুধবার বিকেলে হুমকি দেওয়া বিষয়ে এসব কথা বলেছেন টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ।

এর আগে, নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর বসবাসের উপযোগী কি না, তা দেখা শেষে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নৌবাহিনীর জাহাজে করে চট্টগ্রামে পৌঁছান রোহিঙ্গা নেতারা। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় রাতে কক্সবাজারের শরাণার্থী শিবিরে পৌঁছায় ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা। তার মধ্যে দুই জন নারী সদস্যও ছিল। তবে তাঁরা কেউ ভাসানচরের বিষয়ে ক্যাম্পে কোন ধরনের প্রচারনা না চালালেও ক্যাম্পে ভাসানচর নিয়ে ‘গুজব’ ছড়ানোর খবর তাদের মুখে শুনা গেছে।
এদিকে সরকার ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ওই দ্বীপে পাঠানোর অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নেয়।
শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘তার শিবিরের চার জন রোহিঙ্গা নেতা ভাসানচরে ঘুরে এসেছে। তাদের বিভিন্ন কৌশলে হুমকি দমকি দিয়ে যাচ্ছে মোবাইলের মাধ্যমে। মঙ্গলবার রাত ১২টার পরে আবদুর শুক্কুর ওরফে হুজুর পরিচয় দিয়ে তাকে হুমকি দেয়, ভাসানচর নিয়ে ক্যাম্পে কোন ধরনের প্রচারনা না চালায় তার মাঝিরা। যাতে সেখানে কোন মানুষ না যায়। না হলে পরিনতি ভাল হবেনা। বুধবার রাতে আবার ফোন করবে উল্লেখ করে লাইন কেটে দেন। শুক্কুর উখিয়া কুতুপালং শরাণার্থী শিবিরের যে কোন একটি ক্যাম্পে হতে পারে বলে ধারনা করছেন।
তিনি বলেন, ‘গত বছর রোহিঙ্গাদের ভাসানচর ও প্রত্যাবাসনের সময় সরকারকে যথেষ্ট সহতায় করেছি। তাছড়া সেসময় উৎসাহিত করে তার শিবির থেকে স্বেচ্ছায় দেড়শ মানুষ ভাসানচরে যাবার জন্য রাজি করা হয়েছিল। তখন এ ধরনের হুমকি জামেলা পরতে হয়েছিল। মাঝিরা ভয়ে ফোন বন্ধ রেখেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

উখিয়ার হাকিম পাড়ার শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি হামিদ হোসেন। তিনি মিয়ানমারের মংডু মেরুল্লা পাড়ার বাসিন্দা। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের অভিযানে মুখে পরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি ভাসানচরে দেখতে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের টিম লিডার ছিলেন।
এই রোহিঙ্গা নেতা হামিদ হোসেন বলেছেন, ‘ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশ সুন্দর। তবে সেখানে থাকার ঘরগুলো নিয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। আসার আগের দিন ভাসানচর নিয়ে মতামত চাওয়া হলে সবার পক্ষে থেকে বিষয়টি সেখানকার কর্মকর্তাদের তোলে ধরেছি। ফেরার পর বুধবার পর্যন্ত ক্যাম্পে কোন ধরনের ভাসানচর নিয়ে প্রচারনা চালানো হয়নি। তাছাড়া এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের ‘গুজব’ কানে আসছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে।’
শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি উর্চ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাসানচর দেখে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের হুমকি দিচ্ছে এই ধরনের কথা বার্তা শুনা যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখে আইনি প্রস্তুতি নেওয়া হবে।’
ভাসানচর দেখে ক্যাম্প ফিরে টেকনাফের জাদিমুরা শরাণার্থী শিবিরের হেড মাঝি বলেন, ‘ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশের সর্ম্পকে ক্যাম্পে প্রচারনা শুরু করা হয়নি। তাছাড়া ক্যাম্পে সিআইসিরাও এই বিষয় নিয়ে কিছু বলেনি। একই কথা বলেছেন ফিরে আসা আরও দুই রোহিঙ্গা নেতার।

নাম না বলার শর্তে আরেক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘সত্যিই কথা বলতে মিয়ানমারে জেনোসাইড’র শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। যেতে হলে মিয়ানমারে চলে যাব, ভাসানচরে নই। আবার অনেকে মনে করেন তাঁরা এখন মিয়ানমারের কাছাকাছি আছেন। ভাসানচরে গেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। তাছাড়া অনেকের মাঝে ভয় কাজ করছে।’
এর আগে, পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচর থেকে বলেছিলেন, ‘অবকাঠামো এবং সুন্দর পরিবেশ বিষয়ে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের জানানো হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে, অন্তত প্রতিটি ক্যাম্প থেকে যেন স্বেচ্ছায় কিছু পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়।’
ভাসানচর দেখে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে এখনো প্রচারনা শুরু করেনি বলে জানিয়েছেন টেকনাফের জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে মতে, চারদিনের মাথায় ভাসানচর ঘুরে ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরাণার্থী শিবিরের পৌছান। এর আগে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় (৫ সেপ্টেম্বর) গত শনিবার টেকনাফ থেকে ভাসানচরে নিয়ে আসে সরকার। প্রতিনিধি দলটি চট্টগ্রাম হয়ে শনিবার বিকেল ৫টার দিকে ভাসানচরে পৌঁছায়। তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে কী কী ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে তা বর্ণনা করা হয়। এরপর তাদের (রবিবার ও সোমবার) দুই দিন পুরো আবাসন প্রকল্পের অবকাঠামো ঘুরিয়ে দেখানো হয়েছে। এসময় তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশসহ আরআরআরসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। (৮ সেপ্টেম্বর) মঙ্গলবার রাতে তারা কক্সবাজারের ক্যাম্পে পৌছেছেন।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে।

পাঠকের মতামত: