কক্সবাজার, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গাদের ফেরাতে মিয়ানমার ঐক্য সরকারকে স্বীকৃতি দেবে বাংলাদেশ?

মানবতার খাতিরে মিয়ানমারের ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে কি বিপাকেই পড়ল বাংলাদেশ! এতদিন প্রতিবেশী দেশের গণতান্ত্রিক সরকার ‘রোহিঙ্গাদের নিচ্ছি, নেব’ করে নানা টালবাহানা করেছে। কিন্তু এখন ক্ষমতা দখলকারী জান্তা কোনো রাখঢাক না করেই বলছে, সংখ্যালঘু এ সম্প্রদায়কে ফেরানোর পরিকল্পনা তাদের মাথায় নেই। তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের ভবিষ্যৎ কী?

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারে তা নিয়ে গত শুক্রবার সৌদি সংবাদমাধ্যম আরব নিউজে মতামত লিখেছেন ওয়াশিংটনের নিউলাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির পরিচালক এবং স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউট ইউএস আর্মি ওয়ার কলেজের গবেষণা অধ্যাপক ড. আজীম ইব্রাহিম। জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য তার লেখাটির ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তবর্তী কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পর্যাপ্ত সাহায্য দিতে হিমশিম খেয়েই চলেছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবার – রোহিঙ্গা থেকে শুরু করে তাদের আশ্রয়দাতাদের- জন্য সেরা সমাধান হচ্ছে, শরণার্থীরা তাদের পৈত্রিক ভূমিতে ফিরে যেতে পারা। কিন্তু মিয়ানমারে আগে যেখানে অং সান সু চির অধীনস্থ সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরানোর ভনিতা করত, সেখানে নতুন সামরিক জান্তা ইতোমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এধরনের ভান দেখাতে রাজি নয়।

এতে বাংলাদেশ সরকার অনেকটা চিপায় পড়েছে। একদিকে তারা সচেতন থাকবে যে, মিয়ানমার প্রতিবেশী দেশ, তাই নেপিদোয় যে সরকারই থাক তার সঙ্গে একধরনের সম্পর্ক রাখতে হবে। অন্যদিকে, মিয়ানমারের নতুন জান্তা সরকার মাত্রই এই মুহূর্তে দু’দেশের মধ্যকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক এবং দেশীয়- উভয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ঢাকা এই বিষয়ে চুপচাপ বসে থাকার সম্ভাবনা কম। তাদের অবশ্যই পাল্টা জবাব দিতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু বাদে মিয়ানমারের বাড়তি কোনো চাপ বা বোঝা নেই ঢাকার ওপর, সেজন্য এখানে ছাড় দেয়ারও প্রশ্ন নেই। তদুপরি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের স্থায়ী জনসংখ্যায় পরিণত হওয়া দেশটির ঘরোয়া রাজনীতি কিছুতেই মেনে নিতে দেবে না।

কিন্তু পাল্টা চাপ দেয়া যাবে কীভাবে? উত্তরটি এরই মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যে সামরিক জান্তার ব্যাপক নিন্দা করেছে, অং সান সু চির ক্ষমতাচ্যুত গণতান্ত্রিক সরকার ও মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) গঠিত হয়েছে, আর মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে এনইউজি’র আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সম্ভাবনাও ক্রমেই বাড়ছে।

jagonews24

মিয়ানমারের বর্তমান জান্তা সরকারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রেখে যদি বাংলাদেশের কোনো লাভ না হয়, তাহলে এনইউজি’কে সেখানকার বৈধ সরকার এবং দেনদরবারের একমাত্র কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়।

তবে বাংলাদেশ এখনো ওই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। তারা সম্ভবত জান্তা সংশ্লিষ্ট সকল পথে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে এবং ধীরে (অন্তত ধীরে চলছে বলে দেখাবে) এগোতে চাইবে। তাছাড়া, বাংলাদেশ সম্ভবত এনইউজির পূর্ণ স্বীকৃতিদানকারী প্রথম দেশও হতে চাইবে না। সবশেষ, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে এনইউজির মনোভাবও পরস্পরবিরোধী। কারণ এর সদস্য কিছু এনএলডি (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি) নেতা গত কয়েক বছর রোহিঙ্গা গণহত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন।

তবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইতোমধ্যে এনইউজি’কে তার কাঠামো এবং আন্দোলনে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে চাপ দিচ্ছে। এটি বাংলাদেশের জন্যেও একটি বড় সুযোগ। তাদের রোহিঙ্গা নীতি- নিরাপদ হলে শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যাবে – এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব, যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জাতীয় ঐক্য সরকারের একটি স্বাভাবিক অংশ হতে পারবে।

সুতরাং বাংলাদেশ সরাসরি এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে: তোমরা যদি রোহিঙ্গাদের তোমাদের দেশের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে গ্রহণ করো এবং তাদের স্বদেশে ফেরার পথ করে দাও, তাহলে আমরা তোমাদের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেব।

ঢাকা আপাতত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে প্রকাশ্যে একধরনের আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে তাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, এই প্রচেষ্টার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সুতরাং, পর্দার আড়ালে বাংলাদেশকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারের বিনিময়ে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে এনইউজির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এই মুহূর্তে, মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারের সঙ্গে এমন চুক্তি না হওয়ার চেয়ে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি দেখা যাচ্ছে৷

পাঠকের মতামত: