কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যা করতে চায় সরকার

দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে খুনোখুনি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। নানা কারণে মাঝে মাঝেই রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অন্তত ২২ জন সাধারণ রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্প এলাকায় কোনও না কোনও সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। এতে করে ক্যাম্পগুলোর আশপাশের স্থানীয় নাগরিকরাও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে গত মাসে (ডিসেম্বর-২০২২) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা ও আইন- শৃঙ্খলা সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির এক সমন্বয় সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়। এর আগেও ক্যাম্পে খুনোখুনি হয়েছে। তবে মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্পগুলোর ভেতরে অপরাধ পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এরপর একের পর এক সাধারণ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের বিরোধিতা করতেন মহিবুল্লাহ। এছাড়া তিনি রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে পাচার প্রতিরোধেও সোচ্চার ছিলেন। মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় ও শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করতেন তিনি। পুলিশ বলছে, প্রত্যাবাসনবিরোধী ‘আরসা’র পরিকল্পনায় তাকে হত্যা করা হয়। মহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পর আদালতে দেওয়া পুলিশের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এরপরও বাংলাদেশি নাগরিকসহ অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তারা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্যাম্প এলাকায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের ভেতরে যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নসহ (এপিবিএন) আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য সংস্থাও কাজ করছে। তারা যাতে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে, সেজন্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে আলোচনাও চালানো হবে। এক কথায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে কোনোভাবেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে দেওয়া হবে না। মাদক ব্যবসাসহ নানা অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের বাইরে বেরিয়ে আসা নিয়ন্ত্রণ করতে ক্যাম্পগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনি ও রাস্তা নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে। ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটা তারের বেষ্টনি, ওয়াকওয়ে এবং ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণে কাজ করছে সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে  ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। যেসব কাজ শেষ হচ্ছে সেনাবাহিনী পর্যায়ক্রমে সেগুলো এপিবিএনকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। মনিটরিংয়ের জন্য লাগানো ক্যামেরা কন্ট্রোলরুমের কাজ চলমান রয়েছে। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থীবিষয়ক সেলের তথ্য অনুযায়ী, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের অধীনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চারপাশে কাঁটা তারের বেড়ার সম্পূর্ণ দৈর্ঘ নির্ধারণ করা হয় ১৪৫ কিলোমিটার। এ পর্যন্ত বৃহত্তর কুতুপালং, বালুখালী এবং পালংখালী এলাকার সর্বমোট ৭৪ কিলোমিটার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। টেকনাফে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ৭৪ কিলোমিটার নির্মাণ কাজ শেষ। বাকি ৭১ কিলোমিটার এলাকায় নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। শুধুমাত্র ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত পুলিশের পাশাপাশি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিনটি ইউনিটের এক হাজার ৯২৪ জন সদস্য নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছেন। বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইতোমধ্যে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (ক্যাম্প-২৩) সব রোহিঙ্গা সদস্যকে উখিয়ার মেগা ক্যাম্প এলাকায় স্থানান্তর করে ক্যাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। যাতে আলোচনার মাধ্যমে  অপরাধ কর্মকাণ্ড দমন করতে পারি, সে বিষয়েও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রোহিঙ্গারা সবাই ক্যাম্পে মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে থাকে। এটা বন্ধ করার কাজ চলছে। এজন্য কমিটি করা হয়েছে। তাদের বাংলাদেশি মোবাইল নেটওয়ার্কে  নিয়ে আসারও কাজ চলছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ভেতরে ও বাইরে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে, সেগুলো বন্ধ করতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আলাদা একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তারা শুধু অপরাধীদের নেটওয়ার্ক ঘিরে নজরদারি করবে। সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) একটি ইউনিট। এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ হাসান বারী নূর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যাম্প এলাকার অপরাধ পরিস্থিতি এখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া এপিবিএন-এর আরও দু’টো ব্যাটালিয়ন কাজ করছে।’

তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলতে দু’-একটা ঘটনা তো ঘটেই। সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সন্ত্রাসীদের যেমন পরিকল্পনা থাকে, আমাদেরও এসব বন্ধে কিছু পরিকল্পনা আছে। তবে পরিস্থিতি পুরোপুরিই  নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাতে ও দিনে টহল, চেকপোস্ট, মোবাইল টিম সবগুলোই জোরদার করা হয়েছে। ক্যাম্পগুলো ঘিরে গোয়েন্দা নজরদারি করতে প্রত্যেকটা সংস্থা বা ইউনিটেরই আলাদা ইউনিট ও টিম থাকে। তারা সেটা করছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের সব মেকানিজমই চালিয়ে যাচ্ছি। গত দুই মাসে দুই-একটা খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাৎক্ষণিকভাবে সেসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিয়েছি। চেষ্টা করছি, রোহিঙ্গারা যাতে বাইরে বেরিয়ে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে।’

পাঠকের মতামত: