কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে অপরাধ, স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ বেড়েই চলেছে। পুলিশ জানায়, গত চার বছরে কক্সবাজারে বিভিন্ন অপরাধে হাজার খানেক মামলায় আড়াই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আসামি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরসহ পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে ১২২টি আগ্নেয়াস্ত্র, গত বছরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ৯০টি। এর আগের বছর ২৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এই বছরে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ ওই আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে ৯৬ জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কক্সবাজারের সীমান্ত ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করে ১৪৮টি দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এ সময় ৫শ’ গোলাবারুদ পাওয়া গেছে। এসব আগ্নেয়াস্ত্রসহ অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা ডাকাতকে আটক করা হয়েছে। যাদের বেশির ভাগই ক্যাম্পের বাসিন্দা।

এ বিষয়ে কক্সবাজারের র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘ক্যাম্পে অস্ত্রধারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি বলা যাবে না। তবে এটা সত্য, আমাদের অভিযানের কারণে উখিয়ার তুলনায় টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অনেকটা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার অনেকটা কমেছে।’

তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে শিবিরগুলোতে আট-দশটি গ্রুপ রয়েছে। দুই জায়গার গ্রুপ দুই রকম। টেকনাফে যেসব অস্ত্রধারী রয়েছে তারা ডাকাত দল। যারা পুরনো রোহিঙ্গা। আর উখিয়াতে যেসব অস্ত্রধারী রয়েছে তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। আমরা ইতোমধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশকিছু লোকজনকে আটক করেছি। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার, ক্যাম্প ও পাহাড়ে কোনও অস্ত্রধারী গ্রুপের ঠাঁই হবে না। তাদের গ্রেফতারে অভিযান ও টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

রোহিঙ্গা শিবির নেতা (মাঝি) মো. কামাল বলেন, ‘ক্যাম্পে দিন দিন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। অনেক সময় পাহাড়ি অস্ত্রধারীরা ক্যাম্পে এসে গুলি করে ভয়ভীতি সৃষ্টি করছে। এজন্য এখানকার সাধারণ লোকজন সব সময় আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে। জানি না এই আতঙ্ক কতকাল ভয়ে বেড়াতে হবে?’

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ‘রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় মাদক আর অস্ত্র একই সূত্রে গাঁথা। পাশাপাশি ক্যাম্পে দলগত সশস্ত্র তৎপরতা, মানবপাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল থেকে শুরু করে তুচ্ছ ঘটনায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ক্যাম্পে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তারে দেশীয় নানা অস্ত্রসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে একশ্রেণির রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। বিশেষ করে এখন মাদক পাচারে পাচারকারীরা অস্ত্র ব্যবহার বৃদ্ধি করছে। ফলে ক্যাম্পের বসবাসকারীদের বড় অংশ ভয়ভীতিতে দিন কাটাচ্ছেন।’

রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাম্পগুলোতে কোনোভাবে অবৈধ অস্ত্র থাকতে দেওয়া হবে না। এখানে কীভাবে অস্ত্রগুলো আসছে, তা উদ্ঘাটনের জন্য আমরা কাজ করছি। আমরা এ বছরে সাতটি অস্ত্রসহ ১৬ জন অপরাধীকে আটক করেছি। অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার করা তালিকায় থাকা ক্যাম্পের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দ্রুত ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তালিকায় বলা আছে, ‘আবদুল হাকিম ওরফে হাকিম ডাকাত, মো. মুন্না, মো. সাদেক, সৈয়দ নুর, মো. সেলিম, মো. ফারুক, নুর কবির, আবু সৈয়দ, মো. ইউনুছ, মো. হাসান প্রকাশ কামাল, খলিফা সেলিম, মো. নবী, মোহাম্মদ রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক, নুরু মিয়া প্রকাশ ভুইল্ল্যা, মোহাম্মদ নুর, বনি আমিন, সালমান শাহ, রশিদ উল্লাহ, খায়রুল আমিন, মহি উদ্দিন ওরফে মাহিন, সাদ্দাম হোসেনসহ ৩০ অস্ত্রধারীকে যত দ্রুত সম্ভব ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হলো।’

এ বিষয়টি স্বীকার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ডাকাতদের একটি তালিকা হাতে পেয়েছি। তাদের ধরতে বিশেষ অভিযান চলছে। কোনও অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেকের সঙ্গে কথা হয় এসব ব্যাপারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গারা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় ২০ জনের বেশি অস্ত্রধারী পাহাড়ি সন্ত্রাসী সক্রিয়া রয়েছে। তারা নিয়ন্ত্রণ করছে ৩০টিরও বেশির রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তাদের আটটি গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপে শতাধিক সদস্য রয়েছে।

সামরিক পোশাকে সশস্ত্র রোহিঙ্গা

গত বছর এই সময়ে শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সামরিক পোশাক পরে এবং অস্ত্র হাতে ছবি প্রকাশ করে। সে সময় কুতুপালংয়ে দুটি রোহিঙ্গা প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর ধারাবাহিক সংঘর্ষের পরপরই এ জাতীয় ছবি-ভিডিও প্রকাশ শুরু হয়, যাতে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। এতে দেখা যায়, সামরিক পোশাক পরে গলার কাছে একটি ওয়াকিটকি ঝুলছে, আর দুই হাতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন আমিন নামে এক রোহিঙ্গা। ছবি প্রকাশের কিছুদিন পর পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তবে পুলিশের কাছে আমিনের ভাষ্য ছিল, তাকে জোর করে এই ছবি তুলতে বাধ্য করা হয়েছিল। কর্মকর্তারা বলছেন, তার এ বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘ক্যাম্পে দিন দিন রোহিঙ্গা অপরাধীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যাম্পগুলো পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অস্ত্রধারীদের ধরা কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে তারা বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। তাদের গ্রেফতার করা না গেলে এ এলাকার পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যৌথ অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।’

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩০টি অস্ত্রসহ বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। বিশেষ করে অস্ত্রধারীদের ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে।’

রোহিঙ্গাদের মাদক কারবার সম্পর্কে কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর মাদক কারবারে জড়িত থাকায় কক্সবাজার এলাকা থেকে ২২১ বাংলাদেশি নাগরিক গ্রেফতার হয়। আর সে সময় কক্সবাজারে মাদক কারবারি হিসেবে গ্রেফতার হয় ১০৫ রোহিঙ্গা। বাংলা ট্রিবিউন

পাঠকের মতামত: