কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সিনহা রাশেদ হত্যা মামলা: ঘটনার উৎস ও কারণ খুঁজে পেয়েছে তদন্ত কমিটি

কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যার ‘উৎস ও কারণ’ খুঁজে পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। কমিটি মনে করছে, সেখানে যা ঘটেছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক ছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট মতামত তুলে ধরবে। পূর্বনির্ধারিত ৩১ আগস্টের মধ্যেই তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে। তবে তার আগে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন কমিটির সদস্যরা। এখন পর্যন্ত ৬৮ জনের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাদের সবার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন কমিটির সদস্যরা।

তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল সমকালকে বলেন, ‘তদন্ত কাজ আমরা গুছিয়ে এনেছি। ঘটনার উৎস ও কারণ জানা গেছে।’ ঘটনাটি তাৎক্ষণিক নাকি পরিকল্পিত ছিল- এর উত্তর পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এর উত্তরও পেয়েছি। তবে এটা এখনই মিডিয়ায় বলে দেওয়া ঠিক হবে না। যেসব উত্তর আমরা পেয়েছি তার আলোকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমরা এখন নিজেদের মধ্যে আরও আলোচনা চালাব। এই আলোচনা বা বলতে পারেন নিজেদের মধ্যে বিশ্নেষণের মধ্য দিয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তে আসব।

মিজানুর রহমান বলেন, ঘটনাটি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুর্ভাগ্যজনক ছিল। সিনহার বয়স ৩৫-৩৬ বছর। তার সঙ্গীরা বলেছে, নিরাপত্তার বিষয়ে সিনহা অত্যন্ত সচেতন থাকতেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য, যার নিরাপত্তা বোধ এত তীক্ষষ্ট, তার মতো একটি ছেলেকে এভাবে প্রাণ হারাতে হলো।

গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে এপিবিএনের চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে সিনহা নিহত হন। এ ঘটনা তদন্তে মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা এক সপ্তাহ বাড়িয়ে ৩১ আগস্ট করেছে মন্ত্রণালয়।

তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান, এই তদন্তে কে গুলি করেছে সেটা বের করার কিছু ছিল না। কারণ যিনি গুলি করেছেন, সেটা সবার কাছে শুরু থেকেই পরিস্কার ছিল। লিয়াকত যে গুলি করেছেন, সেটা সে আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও করেছেন। এই ঘটনায় যেটা তদন্তের বিষয় তা হলো, গুলিটা কেন করা লাগল? গুলি এড়ানো যেত কিনা। এটা পরিকল্পিত নাকি তাৎক্ষণিক। গুলির ঘটনার উৎস ও কারণ কী- এসব প্রশ্নের উত্তর তদন্ত কমিটি পেয়েছে। এই ঘটনায় সাক্ষীদের অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন। রেকর্ড শুনে শুনে তা এখন টাইপ করা হচ্ছে।

তদন্ত সূত্র জানায়, মেরিন ড্রাইভে শুধু পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৬৫ জন নিহত হয়েছেন। র‌্যাব ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাও রয়েছে। সিনহার ঘটনায় তদন্ত কমিটি মাদক নির্মূলের ক্ষেত্রে এসব ব্যবস্থার ভুলত্রুটি বিশদভাবে তুলে না ধরলেও পারিপার্শ্বিক কারণে তাদের কিছু মতামত থাকতে পারে। কারণ কক্সবাজার মাদকসহ অন্য অনেক কিছু চোরাইপথে পাচার হওয়ার প্রধান রুট হিসেবে পরিচিত। তদন্ত কমিটি মনে করছে মাদকের ইস্যুটি মূল তদন্তের দূরতম বিষয়। তবু তারা ক্ষুদ্র পরিসরে এ বিষয়ে মতামত দেবেন।

তদন্ত কমিটির একটি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শীসহ ৬৮ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হলেও প্রদীপের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। র‌্যাবের রিমান্ডে থাকায় তদন্ত কমিটি তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। তবে দু-চার ঘণ্টা সময় পেলেও তার সঙ্গে কথা বলতে চায় কমিটি। তার বক্তব্য ছাড়া কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করতে চায় না। এদিকে সিনহা হত্যা মামলার মূল আসামি প্রদীপ কুমার, পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতকে সাত দিনের রিমান্ড শেষে আজ সোমবার আদালতে তোলা হবে। ১৮ আগস্ট কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে হেফাজতে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে র‌্যাব।

গত ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ ঘটনায় নিহতের বোন শাহরিয়া শারমিন ফেরদৌস বাদী হয়ে ৫ আগস্ট টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। মামলাটির তদন্ত করছে র‌্যাব। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র‌্যাব। ওই তদন্তেও বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে।

জানা গেছে, সিনহা ঘটনাস্থলে পৌঁছার ২ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে গুলি করেছিলেন লিয়াকত। এতে লিয়াকত তার নিজের নাকি নন্দ দুলালের অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন, তা নিয়েও তদন্ত চলছে। লিয়াকত গুলি করার কারণ নিয়ে একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন।

পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দরখাস্ত : কক্সবাজার অফিস জানায়, টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, কক্সবাজার সদর মডেল থানার সাবেক ওসি সৈয়দ আবু মো. শাহজাহান কবির, সদর মডেল থানার বর্তমান ওসির দায়িত্বে থাকা মাসুম খানসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি দরখাস্ত দায়ের করা হয়েছে। টেকনাফের হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলম বাবুলকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি হত্যা করার অভিযোগে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গতকাল রোববার এ দরখাস্তটি করা হয়। এ বিষয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় এর আগে আর কোনো মামলা হয়েছে কিনা তা ৩১ আগস্টের মধ্যে জানাতে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্‌। প্রতিবেদন পেলে দরখাস্তটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে। নিহত বাবুলের ভাই বদিউল আলম দরখাস্তটি করেছেন।

পাঠকের মতামত: