কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্লেষণ

স্বপ্নের মৃত্যু হলে আত্মার মৃত্যু হয়

স্বপ্ন শব্দটি কোথা থেকে এলো? প্রথম কখন সে আমাদের মনে উঁকি দেয়, কখন সে ধরা দেয়, কখন সে সুরভী ছড়ায় এবং কখন সে মানুষকে স্বপ্নের চেয়ে বড় হতে শেখায় তা আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষের মধ্যে যার স্বপ্ন যত বড়, তার জীবন তত বড়। স্বপ্ন আছে বলেই তো মানুষ স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করে, বেঁচে থাকে। এমন হতে পারে, কেউ স্বপ্ন দেখেননি, কিন্তু দিব্য দুঃখ-কষ্ট সয়ে স্বপ্ন না দেখে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে সে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে। কিন্তু যখনই কেউ তাকে স্বপ্ন দেখায় অথবা নিজে নিজেই স্বপ্নের লাটাইটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেন, তখন সে আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন ছাড়া প্রকৃত অর্থেই বেঁচে থাকতে পারেন না।

একটি গল্প বলা যাক- এক শহরে এক ভিক্ষুক মাঘ মাসের কনকনে শীতের মধ্যে রাতে এক ধনীর বাড়ি ভিক্ষা করতে গেল। বাড়িওয়ালা ধনী ব্যক্তি ছিলেন নিতান্তই মানবিক ও দয়ালু। স্বল্প বসনের বৃদ্ধ ফকিরকে শীতে কাঁপতে দেখে তিনি অতিশয় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আহা! এই শীতে! কীভাবে এই কাপড়হীন গতরে রাতের অন্ধকারে ভিক্ষা করছেন? একটু অপেক্ষা করুন, আমি ভেতর থেকে আপনার জন্য শীতবস্ত্র আর একটা কম্বল নিয়ে আসি। গরিব ভিক্ষুককে দ্বিতীয় কোনো কথা বলতে না দিয়ে ধনী লোকটি ভেতর বাড়ি অন্তনির্হিত হলেন। কিন্তু ভদ্রলোক অন্য কোনো কাজে আটকে তার আর বৃদ্ধ ভিক্ষুকের কথা ভুলে গেলেন। এদিকে ভিক্ষুক এত দিন স্বল্প কাপড়ে ভালোই বেঁচে ছিল, ভিক্ষা করে খাচ্ছিল। তার যে কাপড়ের খুব অভাব এবং তাকে যে শীতবস্ত্র কিংবা কম্বল পেতে হবে, এমনটি তার মনে হয়নি। সে দিব্যি তার যাপিত জীবনে খুশি মনেই চলছিল। কিন্তু যখনই ভদ্রলোক তাকে গরম কাপড় এবং কম্বলের স্বপ্ন দেখালেন তখনই সে কিন্তু সেগুলো পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। এবং অপেক্ষা করতে করতে সে একসময় তার ভেতরের অপতিরোধ্য শীত নিবারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। অবশেষে যা হওয়ার তাই হলো। সে কিন্তু আর মাত্র একটি রাত শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাঁচতে পারল না, কেননা ওই স্বপ্ন তাকে তার ভেতরের যত প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল, তা ভেঙে দিয়েছিল এবং একটি সময় সে স্বপ্নপূরণ না হওয়ার বেদনায় ধনী লোকটির বাড়ির সামনেই ওই রাতেই শীতের প্রকোপে মারা গেল। সকালে যখন ধনী লোকটি তার দরজায় মৃত ভিক্ষুককে দেখেন তখন তিনি খুবই অনুশোচনা করেন, আহা! কেন আমি ভেতর বাড়িতে গিয়ে এই ভিক্ষুকের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম? একইসঙ্গে তিনি ঠিক এই কথাটিই ভাবেন, যে এই লোকের মৃত্যু শীতের প্রকোপে হয়নি। বরং স্বপ্নহীনতায় তার মৃত্যু হয়েছে। এত দিন সে বেঁচে থাকল আর মাত্র একটি রাত! ধনী লোকটি তার জন্য প্রায়শ্চিত্র করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন।

স্বপ্ন কি পুরোপুরি পূরণ হওয়ার জিনিস? জানি, সবাই বলবেন, নাহ। সব সময় আসলে একটি স্বপ্নকে টার্গেট করে আমরা এগোতে থাকি। যখনি সেটা পূরণ হয়ে যায়, অমনি সেই শূন্যস্থান মুহূর্তেই পূর্ণ করে নেয় নতুন কোনো স্বপ্ন। তাই এটি পূরণ হওয়ার নয়। আর যত দিন আমরা নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাব, মূলত তখন ভাবতে হবে আমাদের নিজস্বতারই মৃত্যু হলো। অর্থাৎ স্বপ্ন বেঁচে না থাকলে পৃথিবীতে কেউ বাঁচতে পারে না। স্বপ্নের মৃত্যু মানে আত্মার মৃত্যু। আর দেহ কি আত্মারও অধিক কিছু? আমারা জানি, দেহের মৃত্যু হয়, কিন্তু আত্মা অবিনশ্বর। তার মৃত্যু হয় না। মাত্র রূপান্তর ঘটে। জাগতিক পৃথিবী থেকে পারলৌকিক জীবনের দিকে ধাবিত হয়।

মানুষের জাগতিক দক্ষতা এবং ক্ষমতা নিয়ে অধ্যয়ন করা সহজ কাজ নয়। মানুষ অত্যন্ত জটিল এবং চিন্তাশীল একটি প্রাণী। তার শারীরিক দক্ষতা, মানসিক চিন্তার শক্তি এবং তার আত্মার অনুষদ পর্যন্ত সব বিষয়ে অনেক জটিলতা রয়েছে। রহস্যময় মানবরাজ্যের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার স্বপ্নের জগৎ। ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনুসারে স্বপ্নেরও কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ হজরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনার সময় একটি বিশেষ ও অর্থবহ অবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে; যেটি ইউসুফ (আ.) তাঁর পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং ইয়াকুব (আ.) তাঁকে এই স্বপ্ন তাঁর ভাইদের কাছে প্রকাশ না করার জন্য বলেছিলেন। কারণ এটি শুনলে তারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। পবিত্র কোরআনে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার সক্ষমতার কথাও বর্ণিত আছে, যেখানে তিনি তাঁর দুই সহকর্মী ও মিসরের বাদশাহর স্বপ্ন ব্যাখ্যা করেছিলেন।

ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা থেকে আমরা এটি শিখেছি যে, কখনো একটি ছোট বাচ্চার স্বপ্নও সত্য হতে পারে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষা এখানে আছে তা হলোÑ আমাদের স্বপ্নগুলো যেন যথেচ্ছভাবে যে কারো কাছে প্রকাশ করা না হয়, বিশেষত যদি তাদের পক্ষ থেকে বিরুদ্ধাচরণ করার সম্ভাবনা থাকে। বরং স্বপ্ন এমন কারো কাছে প্রকাশ করতে হবে যে সৎকর্মশীল। যেমনটি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমাদের এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও, আমরা দেখছি তুমি একজন সৎকর্মশীল লোক।

এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘সত্য স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের একভাগ।’ পবিত্র কোরআনে ইবরাহীম (আ.)-এর স্বপ্নও বর্ণিত হয়েছে, ‘ইবরাহীম (আ.) বললেন, ‘বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বলো, তোমার অভিমত কী? সে বলল, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন।’ (আল-কোরআন-৩৭ : ১০২)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বপ্নের কথাও পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁর রাসুলকে প্রকৃত সত্য স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্য অবশ্যই মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে।’ (আল -কোরআন-৪৮ : ২৭)।

‘সত্য স্বপ্ন’ এই কথাটি থেকে বোঝা যায় যে, সমস্ত স্বপ্ন আসলে সত্য হয় না। বরং কিছু স্বপ্ন আছে যেগুলো অনর্থক মনের চিন্তা-চেতনারই প্রতিফলন, সেগুলো মানুষকে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। সুতরাং, আমরা বলতে পারি স্বপ্ন আসলে অলৌকিক জগতের সঙ্গে আমাদের চিন্তা, চেতনা, সাহস যুক্ত করে এবং আমাদের আত্মার মধ্যে বিদ্যমান কিছু সুপ্ত বাস্তবতাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। এটি সত্য যে, আত্মার সঙ্গে অলৌকিক জগতের সম্পর্ক কেবল স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বাস্তব জগতেও রয়েছে এর সংযুক্ততা। স্বপ্ন সম্পর্কে ভারতের প্রাক্তন প্রেসিজেন্ট এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, স্বপ্নপূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।

লেখক : কবি ও উপাধ্যক্ষ

উপশহর মহিলা কলেজ, যশোর

পাঠকের মতামত: