কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪

হ্যালো, এটা কি ৮-এপিবিএন

রোহিঙ্গা কিশোরী তাইফা (ছদ্ম নাম), কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী পানবাজার ক্যাম্পে পরিবারের সঙ্গে বসবাস তার। প্রতিদিন খাবার পানি আনতে টিউবওয়েলে যেতে হয় তাকে। এ সময় রোহিঙ্গা হোসেন আহমেদ প্রতিদিনই উত্ত্যক্ত করে। সর্বশেষ তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় হোসেন। এ অবস্থায় ‘হেল্প লাইন’ পোস্টার থেকে নম্বর নিয়ে হটলাইনে অভিযোগ করেন কিশোরীর মা। অভিযোগ পেয়ে দ্রুততম সময়ে অভিযুক্ত রোহিঙ্গা যুবককে আটক করে ৮-এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা।

রবিবার (৩ জুলাই) বিকাল সাড়ে ৫টায় উখিয়ার জামতলী ক্যাম্প-১৫ এ ঘটনাটি ঘটে। ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার নারী-শিশুর সহায়তায় হেল্প লাইন সেন্টার চালু করেছে এপিবিএন। গত তিন মাসে এ সেবায় বলার মতো আরও অনেক গল্প তৈরি হয়েছে।

গত ৩০ জুন বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. হারুন ওই হটলাইন নম্বরে কল করে বলেন, ‘পাশের ঘরে এক রোহিঙ্গা যুবক দিল মোহাম্মদ মাদক সেবনের টাকা চেয়ে তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে ব্যাপক মারধর করছে। খবর পেয়ে হেল্পলাইন সেন্টার দায়িত্বে থাকা এক নারী পুলিশসহ ক্যাম্পের টহল টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ওই যুবককে আটক করেন। এ সময় ওই নারীসহ শিশু উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

হেল্প ডেস্কে দায়িত্বরত নারী পুলিশ সদস্য নায়েক নাছিমা আক্তার বলেন,‘একজন রোহিঙ্গা নারী কল করে প্রথমে জানতে চান হ্যালো, এটা কি ৮-এপিবিএন? নিশ্চিত হওয়ার পর এই নারী তার মেয়েকে রোহিঙ্গা হোসেন আহমদ নামে এক ব্যক্তি ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। এরপর দ্রুত আমাদের টহল টিমকে পাঠিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হলে বড় ধরনের ঘটনা হওয়ার সম্ভবনা ছিল। প্রতিদিনই এই হেল্প সেন্টারে অসংখ্য ফোন কল আসে। এর মধ্য বেশির ভাগই নারী ও শিশু নির্যাতনসহ ধর্ষণের অভিযোগ।’

তিনি আরও বলেন, ‘পারিবারিক কলহের কারণে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসে। আমরা অনেক সময় এটি ক্যাম্পের মাঝিসহ কর্তৃপক্ষের বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান করি। আবার কখনও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

রাত-দিন সেবা
এপিবিএন পুলিশ জানায়, বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে ক্যাম্পে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে ‘হেল্প লাইন’ সেন্টার। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু কিংবা অপরাধীদের মারধর ও লুটপাটের হাত থেকে রক্ষায় ভূমিকা রেখেছে এ সেবা। চলতি বছরের মার্চ থেকেই এই হেল্প লাইন নম্বর চালু করা হয়। পানবাজার পুলিশ ক্যাম্প-৯ এ নারী ও শিশুদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে বিশেষ হেল্প ডেস্ক। এই হটলাইনটিতে সার্বক্ষণিকভাবে পর্যায়ক্রমে একজন নারী এপিবিএন সদস্য কাজ করছেন। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এই নম্বরে অভিযোগ এলেই ব্যবস্থা নিতে ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট ব্লকে দায়িত্বরত টহল টিমকে জানিয়ে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, হেল্পলাইন সেবা বিষয়ে রোহিঙ্গাদের ব্যাপকভাবে অবগত করতে ৮-এপিবিএনের আওতাধীন প্রতিটি ক্যাম্পের ব্লকগুলোতে হটলাইন নম্বর সংবলিত ‘স্টপ ডমেস্টিক ভায়োলেন্স’ লিখা পোস্টার ও স্টিকার লাগানো হচ্ছে।

সেবাতে সন্তুষ্ট রোহিঙ্গারা
হেল্পলাইনের সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে বালুখালীর রোহিঙ্গা নেতা মো. হারুন বলেন, ‘এক সময় নারী ও শিশু নির্যাতন হলে কেউ মুখ খুলতো না। অধিকাংশ সময় ক্যাম্পের নারীরা স্বামীর কাছে মারধরে শিকার হন। এখন সেটি অনেকটা কমেছে। কারণ আগে এ ধরনের অভিযোগ দেওয়ার মতো সুযোগ ছিল না। তাছাড়া এ হটলাইনে কোনও ঝামেলাও নেই। এমনকি হটলাইন পেয়ে পুলিশ গিয়ে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাওয়া কিশোরীকেও উদ্ধার করেছে। আবার ড্রেনে আটকে পড়া শিশুকেও উদ্ধার করা হয়। আবার অনেক সময় ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের অবস্থান জানান দিতে ভূমিকা রাখছে। এর ফলে অপরাধও ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘হেল্পলাইন ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এমন সেবা পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ ধরনের হেল্প সেন্টার যাতে উখিয়া-টেকনাফের প্রত্যাক ক্যাম্পে করা হয়, সেজন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি।’

অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে হেল্প লাইন
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় এক ৮০০-৯০০ মতো অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মধ্য কয়েটি ভুয়া ঘটনাও রয়েছে। তবে বেশিরভাগই পারিবারিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যার মধ্যে নারী ও শিশুরাই এর শিকার বেশি হয়েছেন। যৌন হয়রানিসহ ইভটিজিংয়ের মতো অভিযোগও পাওয়া যায়।

হেল্প লাইন বিষয়ে ৮-এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) কর্মকর্তা মো. কামরান হোসেন বলেন, ‘হেল্প লাইন চালু হওয়ায় নারী ও শিশু নির্যাতন রোধের পাশাপাশি দুর্ঘটনায় সহায়তা, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের গ্রেফতার এবং পারিবারিক নির্যাতন বন্ধে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। আর এক্ষেত্রে বেশি তথ্য মিলছে রোহিঙ্গা নারীদের থেকে।’

তিনি আরও বলেন, শুরুতে প্রচুর কৌতূহলী মানুষের ফোন আসতো। এখন এমন ফোন কলের সংখ্যা কমেছে। তাতে এখন আগের চেয়ে ভালোভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পাঠকের মতামত: