কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

হতাশায় আশা ইনসুলিন

ডায়াবিটিস… ডায়াবেটিক রোগী। শব্দগুলো আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। চল্লিশের দোরগোড়ায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। ২০১৮ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৭ কোটি ৭০ লক্ষ, যা গোটা বিশ্বে ডায়াবেটিক রোগীর ১৭.৫ শতাংশ। তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে ভাত, রুটি জাতীয় শর্করা খাবারের প্রাধান্য বেশি বলেই এই রোগের প্রকোপও বেশি। ‘ল্যানসেট ডায়াবিটিস অ্যান্ড এন্ডোক্রিনোলজি’ জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, টাইপ টু ডায়াবিটিসের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ইনসুলিনের পরিমাণ আগামী ১২ বছরে বিশ্বব্যাপী ২০ শতাংশের বেশি বাড়বে।

ইনসুলিন কোনও ওষুধ নয়। এটি একটি সাপ্লিমেন্ট। শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারছে না বলে, বাইরে থেকে তা শরীরে প্রবেশ করানো হয়। ইনসুলিন আবিষ্কারের একশোতম বছর এটি। ১৯২১ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন বিজ্ঞানী স্যর ফ্রেডরিক জি বান্টিং, চার্লস বি বেস্ট এবং জেজেআর ম্যাকলিয়ড ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। পরে তা পরিশোধনের কাজটি করেন জেমস বি কলিপ। ১৯২২ সালে লিওনার্দো থম্পসন নামে চোদ্দো বছরের এক কিশোরের দেহে প্রথম ইনসুলিন ইনজেক্ট করা হয়। ওই কিশোর টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসে ভুগছিল। ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিসের রোগী সাধারণত এক-দু’বছরের বেশি বাঁচতেন না। কিন্তু লিওনার্দো তার পরে তেরো বছর বেঁচেছিলেন।

ডায়াবিটিসের প্রকারভেদ

ডায়াবিটিস ব‌ংশানুক্রমিক রোগ। রক্তের সম্পর্কের কারও থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তবে টাইপ ওয়ানের ক্ষেত্রে জিন ফ্যাক্টর অনেক বেশি জোরালো।

ইনসুলিন নেওয়ার নিয়মাবলি

• ব্যবহৃত ইনসুলিন ফ্রিজে নয়, বাইরে রাখতে হবে

• যে ইনসুলিন ফ্রিজে স্টোর করা দরকার, তা যেন ডিপ ফ্রিজে রাখা না হয়। এমনকি ডিপ ফ্রিজের কাছাকাছি অংশেও নয়, অন্য অংশে রাখুন। ডিপ ফ্রিজে রাখলে ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যাবে

• ব্যবহার করার এক দিন আগে তা ফ্রিজ থেকে বার করে রাখতে হবে

• ইনসুলিনের ইঞ্জেকশন শরীরের একই অংশে রোজ না নেওয়াই ভাল

• ইনসুলিনের সুচে অনেকে ভয় পান। তবে এটি খুব সরু হয়। খালি চোখে প্রায় দেখা যায় না। এবং ঠিক ভাবে ফোটানো হলে তা নার্ভ পর্যন্ত পৌঁছনোর কথা নয়। ত্বকের নীচে চর্বির যে পুরু আস্তরণ থাকে, সেই অংশেই এই ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা

• ইঞ্জেকশন দেওয়ার ক্ষেত্রে হাইজিন বজায় রাখা খুব জরুরি। ইনসুলিন নেওয়ার আগে ভাল করে পরিষ্কার হয়ে নেওয়া প্রয়োজন

টাইপ ওয়ান ডায়াবিটিস: এটিকে ইনসুলিন-ডিপেন্ডেন্ট ডায়াবিটিসও বলা হয়। অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিন তৈরি হয়। কিন্তু টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে শরীর অ্যান্টিবডি দিয়ে প্যানক্রিয়াসের ক্ষতি করে। যার ফলে সেখানে আর ইনসুলিন তৈরি হয় না। এটি অটো-ইমিউন সিস্টেম। কৈশোরেই এই রোগ প্রকাশ পায়।

টাইপ টু ডায়াবিটিস: ডায়াবিটিসে আক্রান্ত রোগীদের নব্বই শতাংশ এই জাতীয়। এ ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন তৈরি করে, কিন্তু শরীরের পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। বা শরীর তা ব্যবহার করতে পারে না। জাঙ্কফুড খাওয়া, অতিরিক্ত মেদ, লাইফস্টাইলের কারণে অবস্থার আরও অবনতি হয়।

ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা কখন হয়?

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কোনও রোগীর ডায়াবিটিস ধরা পড়ার প্রথম তিন মাস যদি তাঁকে ইনসুলিন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য রোগের প্রকোপ তাঁর শরীরে অনেকটা কম হয়। তবে সাধারণ মানুষের ইনসুলিন নেওয়া সম্পর্কে কতকগুলি ভুল ধারণা রয়েছে। তাঁরা অযথা আতঙ্কিত হন। তাই জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল জানালেন, বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে ইনসুলিন দেওয়া হয়ে থাকে…

•তিনটি বা তার বেশি ট্যাবলেট পূর্ণমাত্রায় দিয়েও যখন সুগার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না, তখন সেই রোগীকে ইনসুলিন নিতে হবে।

•এইচবিএওয়ানসি (গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন) –এর পরিমাণ যদি নয়ের বেশি হয়, তখন ইনসুলিন প্রেসক্রাইব করা হয়।

•টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে ইনসুলিন অত্যাবশ্যক।

•গর্ভবতী মহিলার ডায়াবিটিস

ধরা পড়লে তাঁকেও ইনসুলিন দেওয়া উচিত।

•কিডনি অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ইনসুলিন দেওয়া হয়।

•হাসপাতালে রোগী কোনও কঠিন রোগ নিয়ে ভর্তি হলে, তাঁকে ইনসুলিন দেওয়া হয়।

 

ইনসুলিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

যে কোনও ওষুধের চেয়ে ইনসুলিনের সাইড এফেক্ট কম। তবে এতে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খুব শীর্ণকায় ব্যক্তির সুগার ধরা পড়লে, তাঁকে শীঘ্রই ইনসুলিন দেওয়া হয়ে থাকে। ওজন ভারী ব্যক্তিকে ইনসুলিন দেওয়া হলে রিস্ক ফ্যাক্টর বাড়তে পারে।

কয়েকটি বিরল ক্ষেত্রে ইনসুলিন নেওয়ার পরে রোগীর সারা দেহে অ্যালার্জি বা র‌্যাশ বেরোতে দেখা যায়। তাঁদের পরবর্তী সময়ে কোনও ভাবেই ইনসুলিন দেওয়া যাবে না।

আধুনিক যন্ত্রাদি ও তার ব্যবহার

একশো বছরে ইনসুলিন অনেক বিবর্তন দেখেছে। বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে শুরু করে সরাসরি মানুষের ডিএনএ থেকেও ইনসুলিন তৈরি করা যাচ্ছে। ২০০৬ সালে আবিষ্কৃত ইনহেলড-ইনসুলিন কার্যক্ষেত্রে তেমন ফলপ্রসূ হয়নি।

ইনসুলিন নেওয়ার যন্ত্রাদিও উন্নত হয়েছে। তবে চিকিৎসকেরা ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নেওয়াকে এগিয়ে রাখছেন। ইনফিউশন পাম্প নামের একটি অটোমেটেড যন্ত্র আছে যা কোমরে পেজারের মতো লাগানো থাকে। তার মধ্যে একটি সেন্সর থাকে, যা সময়মতো শরীরের শর্করা মেপে নিয়ে ইনসুলিন ইনজেক্ট করে।

তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ইনসুলিন নেওয়া কখনও বন্ধ করবেন না। ইনসুলিন নেওয়ার পর কোনও রকম সমস্যা হলে অবিলম্বে চিকিৎসককে জানানো প্রয়োজন।

পাঠকের মতামত: