কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

আন্তর্জাতিক দিবস আজ

এক বছরে মানবপাচারের ৬২৫ মামলা

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৬ হাজারের মতো মানবপাচারের মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩০০টি। ২০১৯ সালে মানবপাচারের মামলা হয় ৬২৫টি। নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৩৯টি। এ বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবপাচারবিরোধী দিবস। তবে মানবপাচার সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশগুলোর র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। তিন বছর ধরে এ রিপোর্টে দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি তালিকায় ছিল বাংলাদেশ।

এর কারণ হিসেবে বলা হয় অভ্যন্তরীণ ও বিদেশে বিভিন্ন মানবপাচারের ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশিদের জড়িত থাকা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া। লিবিয়ায় ৩০ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনায় বড় ধরনের অভিযানে অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি উঠে আসে প্রতিবেদনটিতে। তবে রোহিঙ্গাদের পাচার নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন তদন্তের আহ্বান জানায় মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে বলা হয়, নৌকা বোঝাই করে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা পাচার ও মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা অনেক শরণার্থীকে জিম্মি করা হচ্ছে এবং তাদের আত্মীয়দের মুক্তিপণ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। আগের তুলনায় এবার অবস্থা পাল্টানোয় বাংলাদেশের র‌্যাংকিংয়ের উন্নতি হয়েছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।

উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর হাজারো মানুষ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। অনেকের বৈধ ভিসা থাকলেও একটি বড় অংশের মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশ নামক মরীচিকার স্বপ্নে বিভোর হয়ে কোনো কিছু চিন্তা না করেই ছোটেন অজানার উদ্দেশে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে যত মানুষ ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা করে, সেই তালিকার শীর্ষ ১০ এ আছে বাংলাদেশ। প্রতিবছর এভাবে ইউরোপ যেতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ ছাড়া মানবপাচারকারীদের হাতে মারা যাচ্ছেন অনেকে। গত মে মাসে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত হন ২৬ বাংলাদেশি। তাদের ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় নেওয়া হয়েছিল।

একই মাসে ভূমধ্যসাগর দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যান ৩৭ বাংলাদেশি। এর এক মাসের মধ্যে ইউরোপে পাড়ি দেওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকা ৬৪ জন বাংলাদেশি অভিবাসন প্রত্যাশীকে তিউনিসিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয়। ইউরোপে এভাবে যাওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। শুধু ইউরোপ নয়, বছর পাঁচেক আগে সাগরপথ দিয়ে হাজারো মানুষের মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে যাওয়ার ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছে এবং নিরাপদ অভিবাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তখন এমন সব চিত্র অনেক বেশি উদ্বেগের।

সূত্র জানায়, গত বছরের মাঝামাঝিতে মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর পর তারা অনেকে গা ঢাকা দিলেও কিছুদিন পর আবার তারা সক্রিয় হয়। অবৈধভাবে বিদেশে পাঠানোর সঙ্গে জড়িত শতাধিক ব্যক্তির একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখায় রয়েছে। যারা স্বল্প খরচে সমুদ্রপথে বিদেশে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে। এদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মানবপাচারকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। মানবপাচারবিরোধী দিবসে সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কোঅপারেশনের (এসডিসি) সহযোগিতায় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এবং উইনরক ইন্টারন্যাশনালের আশ্বাস প্রকল্প আলোচনাসভায় এ কথা বলেন তিনি। নাসিমা বেগম বলেন, মানবপাচার একটি জঘন্যতম অপরাধ। এ অপরাধ নির্মূলের বিকল্প নেই। এ জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। সরকারের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কার্যকর উদ্যোগই পারে মানবপাচার কমিয়ে আনতে।

মানবপাচারবিষয়ক জাতীয় কমিটির দায়িত্বে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, গায়ে মলম দিয়ে এলে ভেতরের রোগ সারানো যাবে না। নজর দিতে হবে মূল সমস্যার দিকে। কারণ আমি মনে করি মানবপাচারের সবচেয়ে বড় কারণ দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকেই পাচারকারীদের কবলে পড়তেন না। তিনি বলেন, মানবপাচার রোধে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগের পাশাপাশি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ দরকার যাতে দেশের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হয়।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোজাফফর আহমেদ বলেন, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর মাধ্যমেই মূলত মানবপাচার বেশি হয়ে থাকে। পাচারের শিকার তারাই হয় যাদের জানাশোনা কম এবং অদক্ষ। দক্ষরা পাচারের শিকার হন না। এ জন্য আমাদের মন্ত্রণালয় কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। প্রতারণা ও পাচারের অভিযোগে আমরা বিভিন্ন এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। ঢাকার আদালতে ১১টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অনেক এজেন্সিকে জেল জরিমানাও করা হয়েছে। আমাদের এ চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

পাঠকের মতামত: