কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘শিগগিরই’ জাতিসংঘ প্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দল যাবে ভাসানচর দেখতে

খুব শিগগিরই’ জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাদের আরো একটি প্রতিনিধি দলকে ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখাতে নিয়ে যাবে সরকার। সোমবার বেনারকে এই তথ্য জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান।

কবে নাগাদ সফরটি হতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, “তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। তবে খুব শিগগিরই।

কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ৩৪টি শিবির থেকে এক লাখ শরণার্থীকে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ওই দ্বীপে নেওয়ার জন্য রাজি করাতে চলতি মাসের শুরুতে দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে ভাসানচর দেখিয়ে আনা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার জাতিসংঘ প্রতিনিধিসহ যাবে দ্বিতীয় দলটি।

“প্রথম দফায় যারা সফর করেছেন তাঁরা ভাসানচরে বসে সেখানকার আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও ফিরে আসার পর তাঁদের অনেকের মাঝে অনাগ্রহ দেখা গেছে। যে কারণে দ্বিতীয় দফায় বিদেশি প্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাদের উচ্চপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের একটি দল সেখানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

“ভাসানচর যে বসবাসযোগ্য, রোহিঙ্গাদের কাছে সেটা প্রমাণ করার জন্যই আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি,” জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “তাই জাতিসংঘের প্রতিনিধিদেরও এবার সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছি। কারণ তাঁদের সমর্থনটাও আমাদের দরকার।

তবে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাকে (ইউএনএইচসিআর) এই উদ্যোগ সম্পর্কে সরকার এখনো কিছু জানায়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের মুখপাত্র মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।

ইতিমধ্যে ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করে তাঁদের মানবিক ও সুরক্ষা পরিস্থিতি এবং নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা যাচাই করতে সেখানে সফর করার জন্য ইউএনএইচসিআর ‘সদাই প্রস্তুত’ বলে জানান সাজ্জাদ।

এ বিষেয় সরকারকে জানানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তা ছাড়া শরণার্থীদের ভাসানচরে নেওয়ার পরে বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে, তাঁদের জন্য সেখানে জাতিসংঘকে প্রবেশাধিকার দেওয়া এখন খুবই জরুরি।

সফর শেষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত

জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ রোহিঙ্গাদের দ্বিতীয় দলটি সফর করে আসার পরে সরকার এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী।

তাঁর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গত মে মাস থেকে ভাসানচরে অবস্থানকারী ৩০৬ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে ফিরিয়ে আনা হবে কিনা সেই সিদ্ধান্তও তখন হবে।

“এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়া মাত্রই তা বাস্তবায়ন করা হবে,” বেনারকে বলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) শাহ রেজওয়ান হায়াত।

অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে গত মে মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৮৬ জন নারী, ৯৬ জন পুরুষ এবং ২৪ জন শিশু।

ভাসানচর সফরকারী রোহিঙ্গা নেতাদের কাছে তাঁরা কক্সবাজারে ফেরার আকুতি জানান। আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীও এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী সেলের প্রধানের পদ ছেড়ে সদ্যই আরআরআরসি-র দায়িত্ব নেওয়া রেজওয়ান বলেন, “তাঁরা এখনো আমাদের এখতিয়ারে নেই। কারণ তাঁদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

অতিরিক্ত আরআরআরসি মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বেনারকে জানান, ভাসানচরে থাকা রোহিঙ্গাদের দেখভাল করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

“এখানে থাকা ৩০৬ রোহিঙ্গা খুবই ভালো আছে। তারা আরাম করে খাচ্ছে-ঘুমাচ্ছে,” গত মাসে বেনারকে জানান ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক ও নৌবাহিনীর কমোডর এ এ মামুন চৌধুরী।

যদিও ভাসানচর সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এটি কারাগারের চেয়েও খারাপ।’ সেখান থেকে সোমবার বিকেলে রোহিঙ্গা নারী আসমা বেগম (১৮) মুঠোফোনে বেনারকে বলেন, “আত্মীয়-স্বজন থেকে দূরে থাকায় এখানে ভালো নেই আমরা। সবাই ক্যাম্পে ফিরে যেতে চাই।”

“১৪ দিন ‘কোয়ারেন্টাইনে’ (সঙ্গনিরোধ) রাখার কথা বলে নিয়ে এসেছিল আমাদের। এভাবে রাখা হলে দম বন্ধ হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।

গত ২৩ ও ২৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সফরকালে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর প্রকল্প নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁদের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, প্রতিনিধিদলে থাকা ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজে তিরিঙ্ক কর্মকর্তাদের বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ভাসানচরে ‘গো অ্যান্ড সি’ একটি ভালো উদ্যোগ ছিল।

“তবে সেখানে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত প্রযুক্তিগত ও সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়নের বাস্তবায়ন জরুরি এবং ইতিমধ্যে সেখানে স্থানান্তরিত ৩০৬ শরণার্থীর পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একটি পৃথক মানবিক ও সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিরিঙ্ক।

শিবিরগুলোয় প্রচারণা শুরু

ভাসানচর দেখে ফেরার ১৭ দিন পর শুক্রবার দুপুর থেকে সেখানকার আবাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে শরণার্থী শিবিরগুলোয় প্রচারণা শুরু করেছেন সফরকারী রোহিঙ্গা নেতারা। এর আগে বৃহস্পতিবার তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ক নির্দেশনা দেন শিবিরগুলোয় দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা।

প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি এমন রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছে নেতাদের। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টেকনাফের জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন।

“প্রত্যেক শিবিরের রোহিঙ্গা নেতারা এই কার্যক্রম শুরু করেছে। আশা করি শিগগিরই এর সুফল পাওয়া যাবে,” বেনারকে বলেন তিনি।

অতিরিক্ত আরআরআরসি সামছু-দ্দৌজা বলেন, “রোহিঙ্গা নেতারা স্বচক্ষে যা দেখে এসেছেন, সেটাই এখন বলছেন।

টেকনাফের জাদিমুরা, শালবন, নয়াপাড়া এবং লেদার পুরোনো ও নতুন শরণার্থী শিবিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বৈঠক করে বা ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের মোবাইলে থাকা ভাসানচর আবাসন ব্যবস্থার ভিডিও ও ছবি দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সেখানে যেতে রাজি করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

এমনই এক বৈঠকে লেদার পুরোনো শিবিরে নেতা নুর বশর বলেন, “সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি টাকা ব্যয়ে অনেক সুন্দর থাকার ঘরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে, যা আমাদেরও পছন্দ হয়েছে। সেখানে গেলে এখানকার চেয়ে অন্তত ভালোভাবে থাকা যাবে।

“তবে কাউকে জোর করা হবে না। স্বেচ্ছায় কেউ যেতে রাজি হলে আগামী শুক্রবারের মধ্যে নাম দেবেন,” বলেন তিনি।

লেদার নতুন রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোস্তফা কামাল বেনারকে বলেন, “সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নারীদের বোঝাতে। কোনোভাবেই তাঁরা সেখানে যেতে চাচ্ছেন না। পুরুষরাও ভেবে দেখতে সময় চাইছেন।

তাঁর শিবিরের বাসিন্দা খতিজা বেগম (৫৫) বেনারকে বলেন, “ভাসানচরে কীভাবে যাব? সেখানে থাকা রোহিঙ্গা নারীরাই তো চলে আসতে চাইছে। তারা যদি সেখানে ভালো থাকত, তাহলে চলে আসার জন্য কাঁদছে কেন?”

জাদিমুরা শরণার্থী শিবিরের নেতা মো. আবুল কালামও বেনারকে বলেন, “ক্যাম্পের অনেকে এখনো ভাসানচর যাওয়ার জন্য রাজি হয়নি। তারা বলছে যদি যেতে হয় রাখাইনে যাবে, ভাসানচরে নয়।

“কক্সবাজার থেকে মিয়ানমার দেখা যায়। আবার জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এসে তাঁদের দেখে যান। সব মিলিয়ে ফেরার আশা নিয়েই সেখানে বেঁচে আছেন তাঁরা। এখান থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে ফেলা কতটা যৌক্তিক হবে?”—এমন প্রশ্ন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) জ্যেষ্ঠ গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদারের।

“এই উদ্যোগ তাঁদের মানসিক সান্ত্বনা দেবে না যন্ত্রণা দেবে তা ভেবে দেখার বিষয়। এর ফলে তাঁদের নিজ দেশে ফেরার আশাটা মরে যাবে,” বলেন এই শরণার্থী পরিস্থিতি বিশ্লেষক।

তাঁর ধারণা, শরণার্থী শিবিরকেন্দ্রিক মাদক ও মানবপাচারের চক্রটিও চাইবে না যে, রোহিঙ্গারা সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাক। এতে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

“রোহিঙ্গা নেতাদের কাছ থেকে ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুকদের তালিকা পাওয়া গেলে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন অতিরিক্ত আরআরআরসি।

পাঠকের মতামত: