কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার চেয়ে দ্বীপবাসীর বিক্ষোভ

সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণে বেকার হবে তিন লাখ মানুষ

বিশ্বখ্যাত প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটক সীমিতকরণ, রাত্রিযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে জীবিকা হারা হবে স্থানীয় বাসিন্দাসহ অন্তত তিন লাখ মানুষ। দ্বীপের মানুষগুলো পুরনো পেশায় ফিরতে গিয়ে বাড়বে অপরাধপ্রবণতা। কর্মসংস্থান হারাবে পর্যটনশিল্পে নিয়োজিত লক্ষাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী।
ঝুঁকিতে পড়বে বিভিন্ন উদ্যোক্তাদের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। তাই জনবিরোধী এমন সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাবিব খান জানিয়েছেন, পূর্বপুরুষ থেকে তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপে বসবাস করে আসছেন। দ্বীপটি পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিত হওয়ার পর থেকে তাদের জীবন-জীবিকার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটন শিল্প বিকশিত হওয়ার আগের অবস্থায় গিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ, প্রবাল উত্তোলন, প্রবাল পাথরকে নির্মাণ কাজে ব্যবহার, মাছের অভয়ারণ্য ধ্বংস, শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে নানা উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবে। এতে দ্বীপের পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে মনে করেন দ্বীপের এই জনপ্রতিনিধি।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যটন মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদফতরের যৌথ সভায় সেন্টমার্টিনে রাতযাপন নিষিদ্ধকরণসহ আরো বেশ কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যা কক্সবাজারের পর্যটন খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশের পর প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দারা। গতকাল শুক্রবার বেলা ৩টায় সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয়রা। তারা কোনোভাবে এই সিদ্ধান্ত মানবে না।

সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা আবদুল মালেক জানান, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করার জন্য অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে প্রতিদিন এক হাজার ২৫০ জন পর্যটক সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে বিদেশী পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে না আসার পাশাপাশি দেশীয় পর্যটক কক্সবাজার ভ্রমণে বিমুখ হবে। এতে সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ ব্যবসা ক্ষতি হওয়ার সাথে সাথে হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে গড়ে উঠা কক্সবাজার পর্যটন ব্যবসাও ক্ষতি সাধিত হবে।

সি-হিলটপ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের প্রোপ্রাইটর এবং টুয়াকের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস এম কিবরিয়া খান জানান, কোভিট-১৯ এর প্রভাবে প্রায় সাত মাস পর্যটন স্পট বন্ধ ছিল। ফলে পর্যটন ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অন্য দিকে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা সরকারি কোনো সহায়তা পায়নি। এমতাবস্থায়, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে পর্যটনশিল্পে ধস নামবে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে পর্যটক ভ্রমণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে দুই শতাধিক ট্যুর অপারেটর ও পাঁচ শতাধিক গাইড এবং লক্ষাধিক পর্যটকসেবী কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের কর্মসংস্থান হারাবে বলে মনে করেন পর্যটনভিত্তিক সংগঠন টুয়াকের সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ।

তার মতে, চলমান অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পর্যটকদের সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের সুযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।

পর্যটন ও পরিবেশের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেন্টমার্টিনদ্বীপ নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনে ১২টি প্রস্তাবনা দিয়েছেন টুয়াকের সভাপতি।

১) সেন্টমার্টিনদ্বীপে পরিবেশ রক্ষার জন্য ক্ষতিকারক সব ধরনের প্লাস্টিকজাত পণ্য ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্লাস্টিকের বিকল্প পণ্যের ব্যবহার ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ।

২) দ্বীপের ভাঙনরোধে মূল ভূখণ্ড থেকে ৫০০ মিটার দীর্ঘ আধুনিক জেটি তৈরির মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করা।

৩) পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক ইকো হোটেল, মোটেল এবং হোম স্টে মডেল তৈরি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৪) দ্বীপে উৎপাদিত সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এবং জেনারেটর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।

৫) দ্বীপের একটি অংশকে পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জীব বৈচিত্র্যের জন্য অভয়ারুণ্য ঘোষণা করা।

৬) পর্যটক এবং স্থানীয়দের ময়লা-আবর্জনা একটি নির্ধারিত স্থানে সংগ্রহ করে অপচনশীল আর্বজনাগুলোকে দেশের মূল ভূখণ্ডে নিয়ে আসা এবং প্লাস্টিক ফ্রি সেন্টমার্টিন ঘোষণার প্রকল্প গ্রহণ করা।

৭) সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভাঙনরোধে জিও ব্যাগের পরিবর্তে চারপাশে বেশি বেশি কেয়াবন তৈরি, নারিকেল গাছ ও ঝাউগাছের বেষ্টনী তৈরি করে বালিয়াড়ি রক্ষা করা।

৮) সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূগর্ভস্থ ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর কর্তৃক সেন্ট্রাল এসটিপি বাস্তবায়নের প্রকল্প গ্রহণ করা।

৯) দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানির চাপ কমাতে সমুদ্রের পানিকে শোধন করে ব্যবহার উপযোগী করার প্রকল্প গ্রহণ করা।

১০) প্রবাল প্রাচীরের সুরক্ষা এবং প্রবাল পাথরের স্তর বৃদ্ধিতে দেশী-বিদেশী বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা।

১১) আন্ডারওয়াটার ন্যাচার সংরক্ষণে পদক্ষেপ গ্রহণ, সমুদ্র তলদেশের প্রবাল উত্তোলন ও মৎস্য প্রজননে ব্যাঘাত ঘটে এমন কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা এবং সচেতনতা সৃষ্টি করা।

১২) ব্লু-ইকোনমিতে মেরিন ট্যুরিজম বিকশিত করতে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে রেসপন্সিবল ইকো ট্যুরিজম মডেল হিসেবে গড়ে তোলা।

সেন্টমার্টিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্তের আগে জেলা প্রশাসন, সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, বিজিবি, পরিবেশ অধিদফতর, ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠান, জাহাজ মালিক, আবাসিক হোটেল মালিক, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, পরিবেশ সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কমিটির মাধ্যমে সমীক্ষা চালানোর দাবি জানান কক্সবাজার হোটেল মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার।

এ দিকে সেন্টমার্টিনে পর্যটক ভ্রমণ সীমিতকরণ ও রাতযাপন নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ট্যুর অপারেট অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার-টুয়াক।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে শহরের একটি কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন- টুয়াকের সভাপতি তোফায়েল আহম্মেদ। তিনি কক্সবাজারের পর্যটনকে বাঁচাতে সব ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা প্রস্তুত আছেন বলে জানান। সেই সাথে পর্যটন খাতের ক্ষতি হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আনুরোধ করেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন টুয়াকের সভাপতি।

গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন টুয়াকের প্রধান উপদেষ্টা ও জেলা জাপার সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান মুফিজ।

এ সময় টুয়াকের সিনিয়র সহসভাপতি আনোয়ার কামাল, সহসভাপতি হোসাইন ইসলাম বাহাদুর, সাধারণ সম্পাদক আসাফ উদ দৌলা আশেক, সাংগঠনিক সম্পাদক ফারুক আজম, যুগ্ম সম্পাদক আল আমীন বিশ্বাস, এস এ কাজল, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক সম্পাদক মো: তোহা ইসলাম, শহিদুল্লাহ নাঈম, মোহাম্মদ ইউছুপ, মোহাম্মদ শিবলি সাদেক, মুহাম্মদ মুসা, জিল্লর রহমান চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, সাইম রহমান অভিসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

পাঠকের মতামত: