কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা কর্মমুখর

রাশেদ মেহেদী::

কেউ নিজের ঘরের সামনে চাষ করছেন, কেউ দোকানে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। হাতে-কলমে সেলাই, বুটিকে নকশার কাজ শিখছেন কেউ কেউ। শিশু-কিশোররা মেতে আছে খেলায়। এমনই কর্মমুখর এখন ভাসানচরে রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পের চিত্র। এই অনাবিল আনন্দের পরিবেশ আগে কখনও পাননি, জানালেন রোহিঙ্গাপল্লির বাসিন্দারা।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কমডোর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানালেন, এখন পর্যন্ত সাত হাজার রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে ১ হাজার ৭০০ একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১ লাখ লোকের বসবাসের সুব্যবস্থা রয়েছে। এই চরের বাকি ব্যবহারযোগ্য জায়গায় আরও প্রায় দুই লাখ লোকের বসবাসের জন্য একই ধরনের সুযোগ-সুবিধার আবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাজের ব্যবস্থা করার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাদের নানা কাজের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সহায়তা কার্যক্রমের জন্য বর্তমানে ৪০টির বেশি এনজিও কাজ করছে। রোহিঙ্গাদের ছোটখাটো চাষাবাদ, গবাদিপশু পালন, হাতের কাজ, সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অনেকেই সেলাইয়ের কাজ করছেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষা এবং ইংরেজি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। এরই মধ্যে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হওয়ার পর ১৪ শিশুর জন্ম হয়েছে, এর মধ্যে একজনের নোয়াখালীতে আর ১৩ জনের জন্ম ভাসানচরেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ভাসানচরে তিন স্তরে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণের কথাও জানান তিনি।
মুখর জনপদে যত ব্যস্ততা :ভাসানচরে রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ এলাকায় ঢুকতেই দেখা গেল বল হাতে ছুটে যাচ্ছে এক তরুণ। সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়ানো একজন। আরও ছয়-সাতজন ফিল্ডিংয়ের জন্য প্রস্তুত। বল হয়ে গেল, সপাটে ব্যাটসম্যানের ব্যাক ড্রাইভ। বল সোজা গড়িয়ে রাস্তার শেষ মাথা পেরিয়ে গেল, চার রান। কথা হলো ব্যাটসম্যান
রুবেলের সঙ্গে। ১৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা কিশোর নিজের ভাষায় জানাল, ক্যাম্পের ভেতরেরও রাস্তাগুলো ফাঁকা। তাই তারা মেতে উঠেছে ক্রিকেট খেলায়। আগে যখন কক্সবাজারে ছিল, তখন এরকম খেলার জায়গা ছিল না। এখানে অনেক জায়গা। বিকেল হলেই ক্রিকেট, ফুটবল খেলার মাঠ হয়ে যায় রাস্তাগুলো। বোলার শহীদুল জানাল, একটা খেলার মাঠ পেলে আরও জমতো।
একটু এগিয়ে সামনে ক্যাম্পের একটা লম্বা ঘরের সারির সামনে খোলা মাঠের মতো। সেখানে মাঠের এক কোণে জমিতে রসুন বুনছেন এক দম্পতি। একটু জায়গা পেয়েছেন, তাই কাজে লাগাচ্ছেন, জানালেন হালিমা-আবু আহমদ দম্পতি। হালিমা জানালেন, কক্সবাজারে জমি-জিরাতে কাজের সুযোগ ছিল না। এখন এখানে এসে সুযোগ মিলেছে। চাষের জমি পেলে চাষাবাদ করতে আগ্রহী তারা। এখানে কথা হলো ষাট বছরের হুরবানুর সঙ্গে। তার অনুযোগ, কক্সবাজারে খাবার দেওয়া হতো বেশি, এখানে একটু কম খাওয়া পাচ্ছেন। খাবারটা বাড়ানোর অনুরোধ জানালেন তিনি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রধান সড়কের সামনে এসে দেখা গেল একটা বড় সুপারস্টোর। তার সামনে শত মানুষের পদচারণায় মুখর সড়ক। সুপারস্টোরের কর্মচারী রুবেল জানালেন, এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হলে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজব্বারের চেয়ারম্যান জামালউদ্দিন গাজী এই সুপারস্টোর দেন মূলত কর্মরত প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিকের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়ার সুবিধার্থে। রোহিঙ্গারা আসার পর এখন এটাই এখানকার সবচেয়ে বড় কেনাকাটার জায়গা হয়ে উঠেছে।
সুপারস্টোরের সামনে বেশ কয়েকটি ছোট দোকান। কোনোটি মুদি দোকান, কোনোটিতে ধোঁয়া ওঠা চা। কোনোটিতে গরম গরম পুরি ভাজাও চলছে। খেলনার দোকানও আছে। মুদি দোকানি শহীদুল জানালেন, ২০১৩ সালে কক্সবাজারে এসেছিলেন তিনি। সেখানে তার কসমেটিকসের দোকান ছিল। গত মাসে ভাসানচরে এসে মুদি দোকান দিয়েছেন। বেচাকেনা দিন দিন বাড়ছে। সপ্তাহে দু’বার লোক এসে দোকানে মালপত্র দিয়ে যায়।
নিজের দেশে যেতে চাই :’সুযোগ-সুবিধা যাই দেন, নিজের দেশে মন পড়ি আছে।’ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন এখানকার রোহিঙ্গাদের ‘মাঝি’ হিসেবে পরিচিত হামিদুল্লাহ। তিনি জানান, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনারা তার ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিলে তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে আসেন। তিনি জানান, এর আগে কক্সবাজারে খুব কষ্ট করে থাকতে হতো, আবার ভয়ও বাড়ছিল। এখন ভাসানচরের ব্যবস্থা অনেক ভালো। কারণ কক্সবাজারে ক্যাম্পের ভেতরে মারামারি, রেষারেষিতে খুব খারাপ অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। এখন শান্তিতে আছেন। ভাসানচরে কোনো মারামারির অবস্থা যেন না হয় সেজন্য তারা নিজেরাও ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং তার ভাষায়, ভাসানচরে আইনের লোকেরাও শান্তিশৃঙ্খলার জন্য খুব সাহায্য করছেন। কক্সবাজারের মতো অবস্থা এখানে সৃষ্টি হবে না বলেই তার দৃঢ় বিশ্বাস।
হামিদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ সরকার যতই সুযোগ-সুবিধা করে দিক, তারা রাখাইনে নিজেদের ভিটেমাটিতে যেতে চান। কারণ, ওটাই তাদের দেশ। তার ভাষায়, ‘মন পড়ি আছে দ্যাশে, এইখানে রিপুজি ক্যাম্পে নয়।’ নিজের দেশে যেতে চান। স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে চান, ছেলেমেয়েদের আরও অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করাতে চান। তিনি বলেন, ‘আর্মিও বুঝি না, সু চিও বুঝি না, নিজের দেশে ফেরত যাইতে চাই।’ তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার যা পুড়িয়ে দিয়েছে, কেড়ে নিয়েছে, তার সবকিছু ফেরত পেতে চান। নিরাপত্তা চান। সেই ব্যবস্থা কেন হচ্ছে না- সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।

পাঠকের মতামত: