কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

ভাসানচরের পথে উখিয়া ছাড়লেন ৩৭৯ রোহিঙ্গা

মোহাম্মদ ইব্রাহিম মোস্তফা::

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সপ্তম দফার প্রথম যাত্রা হিসেবে ভাসানচরের উদ্দেশে উখিয়া ত্যাগ করেছেন রোহিঙ্গারা।

বুধবার (২৪ নভেম্বর) বেলা সোয়া ১১টায় উখিয়া ডিগ্রি কলেজের মাঠ থেকে ১১ টি বাসে ১৬৮ পরিবারের মাঝে ৩৭৯ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রামের নেভাল ঘাটের উদ্দেশে রওনা দেন। সঙ্গে একটি খালি বাসও পাঠানো হয়। সেই হিসেবে ১১ টি বাস বিশেষ নিরাপত্তায় চট্টগ্রামের পথে রয়েছে।

গত এপ্রিলে বর্ষায় যাত্রা স্থগিত করার পর ইউএনএইচসিআর ও সরকারের মাঝে ভাসানচরে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) হওয়ার পর ২৪ নভেম্বর প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা যাত্রা শুরু হয়েছে। এ দফায় প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাবেন বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, ভাসানচরে যাওয়ার উদ্দেশে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে মঙ্গলবার বিকেল থেকে সরঞ্জামসহ সপরিবারে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে আসতে থাকেন রোহিঙ্গারা। বুধবার সকালেও আসেন অনেকে। সকল প্রক্রিয়া শেষ করে ১০টার দিকে বাসে ওঠা শুরু করেন রোহিঙ্গারা। এরপর সোয়া ১১টার দিকে ভাসানচরের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের পথে রওনা হন। আজ সারাদিনে হাজার দেড়েক রোহিঙ্গা যাত্রার পর রাতে চট্টগ্রামের বিএন শাহীন কলেজের ট্রানিজট ক্যাম্পে পৌঁছাবেন। সেখান থেকে পরদিন নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় ভাসানচরে যাওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।

কক্সবাজার ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত জানান, সপ্তম দফায় প্রথম দলের রোহিঙ্গাদের একটি অংশ উখিয়া থেকে ভাসানচরের উদ্দেশ্যে সকালে রওনা দিয়েছে। সারাদিনের যাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না মোট কতজন এবার ভাসানচর যাচ্ছে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরা বলেন, আগের মতো ভাসানচর যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গারা স্ব-স্ব ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে নাম জমা দিয়েছে। ভাসানচরের পরিবেশ, থাকা খাওয়ার সুবিধা সম্পর্কে ব্রিফিং করার পর যারা যেতে রাজি হচ্ছে তাদের নিবন্ধনের মাধ্যমে ভাসানচরে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।

তাদের মতে, আগের মতো তেমন সাড়া মিলছে না। ভাসানচর থেকে পালিয়ে আসা অনেকে বিরূপ প্রচারণা চালিয়েছে। সেখানে বন্দির মতো বসবাস করতে হয় উল্লেখ করে তারা প্রচার করেছে, চাইলেই উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পের মতো সেখানে যখন-তখন কোথাও যাওয়া যায় না। উখিয়া-টেকনাফে থাকা কোনো স্বজন মারা গেলেও সহজে দেখতে আসতে পারবে না বলায় এপ্রিলে যাত্রা বন্ধ হওয়ার পর আবার চালু হলে যাওয়ার জন্য মনস্থীর করা অনেক পরিবার আবার চুপসে গেছে।

আবার রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাসহ সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার কারণে আতঙ্কিত উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের লম্বাশিয়া, বালুখালীসহ বিভিন্ন শিবিরের অনেকে ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। আগে অনেক চেষ্টাতেও তারা ভাসানচর যেতে চায়নি, এমনটি দাবি রোহিঙ্গা নেতাদের।

কক্সবাজার-১৪ এপিবিএনের পুলিশ সুপার নাইমুল হক নাইম জানান, রোহিঙ্গাদের একটি দল বেলা সোয়া ১১টার দিকে ভাসানচরের উদ্দেশ্যে উখিয়া ত্যাগ করেছে। আরও কয়েকটি দল যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ছয় দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়। এছাড়া গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছে।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আগের ও তখনকার মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছে। ওই বছরের নভেম্বরে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে।

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।

ঘর তৈরির পর গত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কয়েক দফায় স্বেচ্ছাগামী প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে পৌঁছালে তাদেরকে দালানের একেকটি ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেয়া হয়। রোজার পর সেখানে অবস্থানকারীদের জন্য উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদের জামায়াত ও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু যাযাবরের জীবন অতিবাহিত করা রোহিঙ্গাদের অনেকে ভাসানচরের জীবন ফেলে সেখান থেকেও পালাতে শুরু করেন। রাতের আঁধারে ছোট নৌকায় নদী পার হতে গিয়ে ডুবে মরার ঘটনাও আছে। অনেক রোহিঙ্গা একে ‘বন্দিজীবন’ বলে অভিহিত করছেন।

পাঠকের মতামত: