কক্সবাজার, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

প্রচারের অভাবে সাড়া মেলেনি রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে

নোয়াখালীর ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পাশাপাশি দেশের ছিন্নমূল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেও সেখানে পুনর্বাসন করতে চেয়েছিল সরকার। এ লক্ষ্যে মার্চে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দরিদ্র ও ছিন্নমূলরা সেখানে যেতে চাইলে ডিসির কাছে আবেদন করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার। কিন্তু সরকারের এ পদক্ষেপে সাড়া দেয়নি কেউই। উৎসাহ দিয়ে ছিন্নমূল ও দরিদ্রদের ভাসানচরে নেওয়ার কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত একটি পরিবারও

ভাসানচরে যেতে আবেদন করেনি। অথচ দেশে দদ্রি মানুষের সংখ্যা কমবেশি ৫ কোটি। ছিন্নমূল মানুষ আছে কয়েক লাখ।

কর্মকর্তারা জানান, দরিদ্রদের ভাসানচরে নিতে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে কোনো প্রচার নেই। ফলে ভাসানচরে যাওয়ার যে একটা সুযোগ আছে সেটিও সাধারণ মানুষ জানে না। কার্যত ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এ পুনর্বাসন কার্যক্রম।

অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকারের প্রস্তুতি শেষ হলেও তারা সেখানে যেতে চাচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গা স্থানান্তরও বন্ধ রয়েছে। তবে গত মাসের শেষের দিকে সাগরে ভাসমান অবস্থায় দুই দফায় ৩০৬ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে ভাসানচরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তারা সেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এসব রোহিঙ্গাকে দেখভাল করছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভাসানচরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ঘরবাড়ি, সাইক্লোন শেল্টারসহ বসবাসের জন্য সব অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। যারাই ভাসানচরে যাবেন তাদের জন্য হাঁসমুরগিসহ গবাদিপশু পালন, মাছচাষ ও অন্যান্য কৃষি কাজের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে সরকার। তবু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং দেশের ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষ সেখানে যেতে চাচ্ছে না। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের আগে কারিগরি মূল্যায়ন শেষে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।

এদিকে কয়েক জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ভাসানচরে ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষকে ভাসানচরে স্থানান্তরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। মানুষকে বিষয়টি ভালোভাবে জানানোও হচ্ছে না। তবে কোনো কর্মকর্তার ভাষ্য, করোনা মহামারী নিয়ে সরকার এখন ব্যস্ত। এখন গুরুত্ব বিবেচনায় কাজ হবে। ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর বা ছিন্নমূল মানুষদের নেওয়ার বিষয়ে এখন হাত দিতে চাচ্ছে না সরকার। এ কারণে ভাসানচরে দরিদ্র মানুষকে পুনর্বাসনের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

উত্তরবঙ্গের একটি জেলার ডিসি জানান, ভাসানচরে ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষকে পুনর্বাসন করার বিষয়টি আমাদের দাপ্তরিকভাবে জানানো হয়নি। ফলে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিও না। অবশ্য অন্য আরেক ডিসি জানান, কেউ যেতে আগ্রহ দেখালে তাদের আবেদন নিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, আমরা মানুষকে ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে জানিয়েছি। কিন্তু একজনও সেখানে যেতে আবেদন করেনি। কারণ হাতিয়া থেকে স্পিডবোটে গেলেও ৪০ মিনিট সময় লাগে। কেউ আবেদন করলে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেখানে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আসলে মানুষ মূল ভূখন্ড ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না বলেই আমরা ধরে নিয়েছি। নোয়াখালীর ডিসি তন্ময় দাস বলেন, আমরা এ বিষয়ে ইউএনও এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের জানিয়েছি। কেউ ভাসানচরে আবাস গড়তে চাইলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ ভাসানচরে যেতে আবেদন করেনি।

কর্মকর্তারা জানান, গত মার্চে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি জেলা থেকে ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক মানুষের তালিকা করতে ডিসিদের চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ভাসানচরে মানুষের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন ও জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগ্রহী জনগোষ্ঠী সরকারের কাছে লিখিত আবেদন করতে পারে। সেখানে বসবাস ও জীবিকা নির্বাহের সুবিধা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তালিকা পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শাহ্ কামাল বলেন, ভাসানচরে বর্তমানে ৩০৬ রোহিঙ্গা আছে। তাদের আমরা দেখাশোনা করছি।

রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ভাসানচর বসবাসের উপযোগী কি-না তারা আরও মূল্যায়ন করছে।

ভাসানচরে বাংলাদেশি ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষকে পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ কতটুকু এগিয়েছে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা তাদের নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা সাড়া দিচ্ছে না। ফলে এই পদক্ষেপ এখন আর চলমান নেই। আমরা ওই বিষয়ে এখন আর কিছু ভাবছি না।

এদিকে ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা তাদের জন্মভিটা ছেড়ে অর্থাৎ মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ভাসানচরে যেতে চান না। পরিবার নিয়ে তারা নিজ এলাকাতেই থাকতে চান। এরকম একজন রহিম উল্লাহ। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার বাসিন্দা। পাঁচ সন্তানের জনক। তিন সন্তান স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। তারা মাসিক বৃত্তিও পায়। রহিমের জায়গা-জমি নেই। এলাকার এক বিত্তশালীর বাড়িতে রায়ত থাকেন। কামলা খেটেই সংসারের খরচ মেটান। রহিম উল্লাহ বলেন, সুখে-দুঃখে নিজ এলাকাতেই আছি। এখানে আত্মীয়-স্বজনরা থাকে। সবাইকে সব সময় পাই। আমার অভাবের সংসার। আমার মাসিক আয় প্রায় ৮-১০ হাজার টাকা। এই টাকায় পরিবার নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছি তবু ভালো। ভাসানচরে আমারে দেখবে কে? সব ছেড়ে ভাসানচর যাব কোন দুঃখে।

দরিদ্রদের ভাসানচরে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমেদ কায়কাউস বলেন, আমি তো জানি সেখানে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হবে। দেশের দরিদ্র ছিন্নমূল মানুষকে সেখানে নেওয়ার বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নেব।

পাঠকের মতামত: