কক্সবাজার, রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

একটি হত্যা : অনেক প্রশ্ন

হত্যা কিংবা মৃত্যু বাংলাদেশের মানুষের কাছে ডাল-ভাতের মতো একটি বিষয়। প্রতিদিন যা হচ্ছে তা নিয়ে বিশেষ কী আর ভাবনা থাকবে! শুধু বাংলাদেশে বললে ভুল হবে- পৃথিবীর অনেক দেশেই আজ এমন অবস্থা বিরাজ করছে। এখন মৃত্যু যেন স্বাভাবিক এক ঘটনার নাম। কিন্তু কখনো কখনো একটি মৃত্যু বা হত্যা আমাদের ঝাঁকুনি দিয়ে যায়, বড় রকম ধাক্কা দিয়ে যায়।

সম্প্রতি আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ ফ্লয়েডের মৃত্যু কিংবা হত্যাও এমন কিছুই ছিল। পুলিশের হাতে তার এ মৃত্যু শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্ববিবেককে বড় রকম ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের কোটি কোটি মানবতাবাদী মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে হাঁটু গেড়ে ফ্লয়েডকে স্মরণ করেছে। বিরাট ঝাঁকুনি দিয়ে আমেরিকার পুলিশ বাহিনী নিয়ে জাতীয়ভাবে নতুন সংস্কারের চিন্তা করার মতো যথেষ্ট ওজনের বাতাস বয়ে গেছে আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে। শুধু অপরাধী পুলিশ অফিসারের বিচারই সেখানে শেষ কথা হয়নি।

বাংলাদেশে এমনই একটি ঝাঁকুনি দেওয়া হত্যাকা- ঘটে গেছে গত ৩১ জুলাই। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। রাত ৯টা। টেকনাফ থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে নিজস্ব প্রাইভেট কারে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের ছাত্র সাহেদুল ইসলাম সিফাত।

রাত ৯টায় সিনহার গাড়িটি এসে পৌঁছে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে। পুলিশের নির্দেশনা পেয়ে প্রথমে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামলেন সিফাত। এর পর নিজের পরিচয় দিয়ে হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নামলেন মেজর (অব.) সিনহা। সিনহার বুকে এর পর একে একে চারটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি করেছে পুলিশ। তাতে বলা হয়েছে, চেকপোস্টে গাড়িটি পুলিশ তল্লাশি করতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন।

এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ওই সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা পিস্তল বের করলে পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালায়। এর পর দ্রুত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে ইনচার্জ লিয়াকতসহ তদন্ত কেন্দ্রের সব সদস্যকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মাদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

পরে জানা যায়, লিয়াকত গুলি চালানোর আগে ওসি প্রদীপ দাসের অনুমোদন লাভ করে। কক্সবাজারের এসপি এবিএম মাসুদ এই হত্যাকা-ের পর ফোনে ইন্সপেক্টর লিয়াকতকে মিথ্যা বলার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। মনে হওয়ার অবকাশ রয়েছে- ইন্সপেক্টর, ওসি এবং এসপি পুরো যেন মৃত্যুপুরীর পরিচালক ও কলাকৌশলী।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী মেজর (অব.) সিনহার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দেন। ৫ আগস্ট মেজর (অব.) সিনহার বোন কক্সবাজার জুুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওসি প্রদীপ কুমার দাস এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীসহ ৯ জন পুলিশকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ্ ফৌজদারি মামলাটি আমলে নিয়ে টেকনাফ থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করতে নির্দেশনা প্রদান করেন।

মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবকে দেওয়া হয়। র‌্যাব ৬ আগস্ট ওসি প্রদীপ দাস এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ তিনজন আসামিকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যৌথভাবে সেনাপ্রধান এবং আইজি। তারা সম্মিলিতভাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘটনায় ব্যক্তি জড়িত, বাহিনী নয় এমন একটি বক্তব্য দিয়েছেন।

আমাদের আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে অর্থাৎ পরিপূর্ণ রিপোর্ট জানতে তদন্ত দলের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে পুলিশ, অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা, সংবাদকর্মীদের রিপোর্ট, সঙ্গে থাকা সিফাতের বর্ণনা সবকিছু নিশ্চিতভাবে একটি বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে- পুলিশ ইন্সপেক্টর লিয়াকত গুলি করে মেজর সিনহাকে হত্যা করেছেন। ঘটনার আগে-পরে কী কী আছে তা না হয় পরেই জানব।

কিন্তু যেটুকু সূর্য-চাঁদ-পৃথিবীর মতো সত্য, তা হলো পুলিশ চেকপোস্টে একজন নিরপরাধ মানুষকে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে একটি সংবিধান আছে, পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাজের এবং ক্ষমতার পরিধি আছে, পুলিশ বাহিনীর কার্যপ্রণালি বিধি আছে। কোনো জায়গায় কি লেখা আছে- পুলিশ তল্লাশি করতে যে কাউকে গুলি করতে পারবে? তা হলে লিয়াকত নামের ইন্সপেক্টর কীভাবে তা করার দুঃসাহস দেখাতে পারেন? কীভাবে ওসি তা অনুমোদন করেন? কীভাবে এসপি ভিন্ন গল্প তৈরি করার ব্যাপারে সাহায্য করেন? কীভাবে আবার তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিহত ব্যক্তি এবং একমাত্র নিরপেক্ষ সাক্ষীকে আসামি করে মামলা দায়ের করতে পারেন?

ইন্সপেক্টর হত্যাকারী এবং ওসি মদদদাতা। এর পর এসপি একই সুরে কথা বলেন। পুলিশ বাহিনীর চেইন-ইন-কমান্ড যদি এভাবে হত্যাকারীর সঙ্গে তাললয় জুগিয়ে দিতে থাকে, তবে একটি শৃঙ্খলাযুক্ত বাহিনীর শেষ কথাটি কী হতে পারে? গুলিটি পুলিশ বাহিনী করেনি এটা দিবালোকের মতো সত্যি ঘটনা। কিন্তু গুলি করা ইন্সপেক্টর পুলিশ বাহিনীরই দায় এবং হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্রটির মালিক পুলিশ বাহিনীই।

তাই এটি ব্যক্তি কার্যকলাপ হলেও পুলিশ এ দায় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে না। এতে বোঝা যায়, পুলিশের শৃঙ্খলা এবং চেইন-ইন কমান্ড একটি ভঙ্গুর পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। লিয়াকতের মতো পুলিশ সদস্যরা তাদের সরকারি দায়িত্বকে তাদের ব্যক্তিগত ক্ষমতার বাহন বলেই ধরে নিয়েছেন। নির্ভয়ে তাই ইন্সপেক্টর লিয়াকত একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজরের পরিচয় জানার পরও পিস্তল বের করে গুলি করে দিতে পারেন। লিয়াকত বা ওসি নিশ্চয়ই হত্যা করার এই সংস্কৃতিতে পাকা খেলোয়াড় হয়ে উঠেছেন। সেখানে তাদের দেখার কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কর্তৃপক্ষ আছে কিনা তা বিবেচনা করার ইচ্ছাটাও তাদের হয়তো জাগ্রত হয়নি। পাখি মারার মতো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাছে হত্যাকা-গুলো। ইতোমধ্যে ওসি প্রদীপ, ইন্সপেক্টর লিয়াকতসহ ৭ পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

মেজর (অব.) সিনহা অত্যন্ত দক্ষ এবং চৌকস সেনা অফিসার ছিলেন। একজন দক্ষ মেজর তৈরি করার পেছনে একটি দেশের শ্রম-অর্থ কতটা ব্যয় করতে হয় তা একজন পুলিশ সদস্য না-ই বুঝতে চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু পুলিশ কার্যকলাপের আবহাওয়ায় তার গুরুত্ব সঠিকভাবে উপস্থাপিত না থাকলে এমন দুর্ঘটনার সুযোগ তৈরি হয়ে যায়। ওসি প্রদীপ দাসও একজন দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টর অন্তত পুলিশের হিসাবের খাতায়। ২০১৯ সালে তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ পদ (বিপিএম) লাভ করেন। একাধিকবার তিনি রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) পান। নতুন করে প্রশ্ন জাগে- তাকে পদক প্রদানের প্রেক্ষিত এবং গ্রহণযোগ্যতায় কোনো ত্রুটি আছে কিনা?

কোনো দ্বন্দ্বের সুযোগ নেই যে, ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে এবং দ্রুত বিচার করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এখনো প্রধান সাক্ষী সিফাত পুলিশের হেফাজতে আছেন। সাক্ষীদের সুরক্ষা করতে হবে রাষ্ট্রকে এবং পুলিশকে। এই হত্যাকা- পুলিশ বাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ছাত্র রাজনীতির পরিচয় এবং জন্মস্থানের পরিচয় পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার মতো এমন কিছু কার্যকলাপ পুলিশসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থায় বহমান আছে। এগুলো সরকারকে বিব্রত করছে, রাষ্ট্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থাকে সবার কাছে হেয় করছে। মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু এবং সুষ্ঠু বিচার দিয়ে এই সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটানোর চিন্তা করা যেতে পারে।

পুলিশ জনগণের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে। তাকে সৎ রাখা, স্বাভাবিক কর্তব্যরত রাখা, দায়িত্বশীল করা সরকার এবং রাষ্ট্রের অত্যন্ত সচেতনভাবে চিন্তা করার একটি জায়গা। এক ফ্লয়েড়ের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীতে অনেক বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তেমনই মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যুটি বাংলাদেশ পুলিশের কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারলে তা বাংলাদেশেরই উপকার হবে। বাংলাদেশ পুলিশের ওসি পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্ষমতাধর একটি পদ। ওসি নিয়োগটি এখনো ইন্সপেক্টর পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। অনেক ইন্সপেক্টরের জন্যই এই পদের গুরুত্ব এবং ক্ষমতা সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তির সঙ্গে পদের মিলনটি ঠিক বেমানান হচ্ছে। তাই অনেক ওসি ঠিক থাকলেও ক্ষমতার দাপটে অনেকে আবার বেসামাল হয়ে পড়ছেন। এদিকটা পুলিশ এবং রাষ্ট্রকে গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। একজন ওসির ক্ষমতা এবং গুরুত্ব সঠিকভাবে ধরে রাখতে এই পদে একজন উচ্চ পদস¤পন্ন অফিসারকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। একজন ওসিকে থানার সব অফিসার এবং কনস্টেবলকে কন্ট্রোল করতে হয়, যেখানে বেশ কয়েকজন ইন্সপেক্টর লেবেলের কর্মকর্তা থাকেন। একজন ইন্সপেক্টর হয়ে অন্য ইন্সপেক্টরদের পরিচালনা করা অনেক সময় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই ওসির পদটিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ কোনো অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এএসপি) র‌্যাংকের একজন অফিসারকে ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে ইন্সপেক্টর পদোন্নতি পেয়ে ইন্সপেক্টর এবং এসপির মাঝপথে ডিএএসপি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ থানায় এই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। একটি উপজেলা লেভেলে সরকারের প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার হিসেবে ইউএনও নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিনি থাকেন সিভিল প্রশাসনের দায়িত্বে। উপজেলা লেভেলের অন্যান্য অনেক অফিসারও গেজেটেড অফিসারের সমতুল্য পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু একটি উপজেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পুলিশের ওসির পদটি এখনো একজন ইন্সপেক্টরের হাতে থাকায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বাস্তবতা লক্ষ করা যায়।

মেজর (অব) সুধীর সাহা : কলাম লেখক

পাঠকের মতামত: