‘আমার একটা চায়ের দোকান ছিল। ২০১৭ সালে ক্যাম্প তৈরির পরে আমার বাড়ি ও দোকান ক্যাম্পের মধ্যে পড়ে যায়। এই দোকানে আর বাইরের লোক আসতে পারে না। রোহিঙ্গারা তাদের নিজেদের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। দিনের পর দিন কাস্টমার না পেয়ে দোকান বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিয়ে দিই। এখন ওটা ওরাই চালায়। ক্রেতার অভাব নেই, কিন্তু আমার চলে কী দিয়া?’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া এলাকার এক স্থানীয়। লম্বাশিয়া ক্যাম্প এলাকায় কথা হয় ‘হোস্ট কমিউনিটির‘ আরও কয়েকজনের সঙ্গে। এখানে বেশকিছু বাসিন্দার ঘর পড়ে গেছে ক্যাম্পের মধ্যে। তাদের অভিযোগ, ‘কোথাও যেতে হলে ক্যাম্পের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাইরে যে নিরাপত্তা চৌকি আছে, তাদের কাছে প্রতিবারই প্রমাণ দাখিল করতে হয় যে তারা রোহিঙ্গা নন। নিজের ঘরে পরবাসী কতদিন?’
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ অঞ্চলে সবশেষ ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশের পর তাদের জায়গা করে দিয়েছিল স্থানীয় মানুষ। গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতায় সেই সৌহার্দ্য কমে এখন পারস্পরিক ‘বিদ্বেষে’ পরিণত হচ্ছে। এই রোহিঙ্গা আবাসন দীর্ঘস্থায়ী হলে আগামীতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাবের শঙ্কা করছে ‘হোস্ট কমিউনিটি’র নেতারা। অন্যদিকে রোহিঙ্গারা সরাসরি কোনও অসন্তোষ প্রকাশ না করলেও তাদের তরুণ প্রজন্মের (১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী) দাবি, হোস্ট কমিউনিটি তাদের মাধ্যমে লাভবান হয়েছে। তারা মনে করে, ‘হোস্ট কমিউনিটি আরও বেশি সহানুভূতিশীল হতে পারতো।’
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরু থেকেই কাজ করছে, এমন বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, ২০১৭ সালের তুলনায় বর্তমানে রোহিঙ্গা এবং হোস্ট কমিউনিটির মধ্যে সামাজিক সংহতির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে। ২০২০ সালে কোস্ট ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বাগতিক দেশ হিসেবে সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত ৪ বছরে রোহিঙ্গাদের প্রতি স্বাগতিক সম্প্রদায়ের সহানুভূতিশীল মনোভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ক্যাম্প এলাকায় অপ্রত্যাশিত বেশ কিছু ঘটনা হোস্ট সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে; যা সামাজিক সংহতির পরিবেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে।
কেন সহানুভূতি চলে গেলো?
উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন এলাকার হোস্ট সম্প্রদায়ের সদস্যরা মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রথমে সহানুভূতিশীল ছিলেন। সেসময় তাদের সহায়তার প্রচেষ্টাকে আন্তর্জাতিকভাবেও উল্লেখযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এই ক্যাম্প দীর্ঘস্থায়ী হওয়া এবং প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দুর্বৃত্তের সহিংস আচরণের কারণে শুরুর সময়ের সেই সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে।
হোস্ট সম্প্রদায়ের এক শিক্ষার্থী বলছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকে আমরা বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। প্রধান অসুবিধা হল স্থানীয় এলাকায় পণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি। পরবর্তী সমস্যা হল দিনমজুরের জন্য দৈনিক মজুরি কমানো। কারণ অনেক রোহিঙ্গাই ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের কোনও অনুমোদন ছাড়াই পার্শ্ববর্তী হোস্ট কমিউনিটি এলাকায় কাজ শুরু করেছে।
হোস্ট সম্প্রদায়ের সব উত্তরদাতারা তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। এই অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে তারা তাদের দৈনন্দিন সামাজিক জীবনযাত্রার ব্যাঘাত প্রত্যক্ষ করেছে বলেও উল্লেখ করেন। তারা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, স্থানীয় ব্যবসার সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু একই সময়ে, ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বেড়েছে।
রোহিঙ্গারা আক্রোশ প্রকাশ করে না
হোস্ট কমিউনিটি তাদের অভিযোগের কথা প্রকাশ করছেন। তবে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা হোস্ট সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে না। সামনাসামনি তারা সাধারণত বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞ মনোভাব প্রকাশ করে। হোস্ট সম্প্রদায়ের সদস্যের প্রতি তাদের সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। যদিও একাধিক ক্যাম্পে গিয়ে তার বিপরীত পরিস্থিতিও দেখা গেছে।
বালুখালী ক্যাম্প ৯ এর এক রোহিঙ্গা গৃহবধূ বলেন, ‘আমরা ত্রাণ পাচ্ছি, তবে আমরা এখানে একটি কঠিন জীবনযাপন করছি। কারণ আমরা শুধু ন্যূনতম জীবনযাত্রার সহায়তা পাই। বাকি সবকিছুর জন্য বাড়ির পুরুষদের নানাভাবে টাকার জোগাড় করতে হয়। বাংলাদেশ সরকার আমাদের জন্য যা করেছে, তার কোনও তুলনা নেই। কিন্তু তারপরও আমাদের কোনও ভবিষ্যত নেই। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের অনেকেই ঠিক গ্রহণ করতে পারে না।’
কিছু রোহিঙ্গা এও মনে করে যে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের আগমনের কারণে হোস্ট সম্প্রদায় বর্ধিত চাকরি এবং অন্যান্য সুযোগ থেকে উপকৃত হয়েছে। তারা এসেছিল বলেই এই এলাকা বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছে। রোহিঙ্গা তরুণ প্রজন্ম মনে করে, তারা আসার কারণে এলাকার শুধু না চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী এখানে এসে ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে।
দিনমজুরের কাজ করেন, ক্যাম্পের ঘর সারাই করেন এমন এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘ক্যাম্পে আমাদের কোনও আয় নেই। কারণ আমাদের ক্যাম্পের বাইরে কাজে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ত্রাণসামগ্রীর ওপর নির্ভর করে আমাদের জীবনযাপন করতে হবে। কখনও কখনও, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে আমাদের ত্রাণের জিনিসপত্র বিক্রি করতে হয়। এইটা কোনও জীবন হতে পারে না।’
হোস্ট কমিউনিটি ও রোহিঙ্গাদের পারস্পরিক অভিযোগ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট ডাটা নেই। তবে অভিযোগ বাড়াটাই স্বাভাবিক। বাড়িতে কোনও গেস্ট এসে যদি বছরের পর বছর থাকে, সেখানে সম্পর্কটা আর সৌহার্দ্যের জায়গায় থাকে না। এক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটছে। যেহেতু হোস্ট কমিউনিটির দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ে, সেহেতু তাদের অভিযোগ বেশি হবে সেটাও স্বাভাবিক।’
পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেন এই অভিযোগ থেকে অন্য কোনও ধরনের পরিস্থিতি তৈরি না হয়। তবে অভিযোগ থাকাটা ইতিবাচকও। এতে করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মনে সবসময় একটা বিষয় থাকবে যে, তারা এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থাকার জন্য আসেননি, তাদের দেশে ফিরতে হবে।’
দ্রুত রোহিঙ্গাদের ফেরানোর উপায় বের না করতে পারলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে উল্লেখ করে পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তাদের খারাপ সময়ে দিয়েছি। এখন তাদের ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। শুরু থেকে আমাদের মনে হয়েছে, এরা একবার ঢুকে গেলে আর ফেরানো সহজ হবে না। এখন ক্যাম্পগুলোতে তাদের যেভাবে দেখভাল করা হয়, আমাদের স্থানীয়দেরও সেই সুযোগ-সুবিধা নেই। কিন্তু স্থানীয়রাও কম বিপদের মুখে পড়েনি। এখন ক্যাম্পে-ক্যাম্পে সহিংসতা বেড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে পুরো প্রক্রিয়ার তথ্যাদি সঠিকভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।’ রোহিঙ্গাদের জন্য হোস্ট কমিউনিটি কাজ পেয়েছে, গ্লোবালি পরিচিতি পেয়েছে- রোহিঙ্গাদের এমন ধারণাও সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পাঠকের মতামত: