কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

অপ্রচলিত ফল চাষে বাড়তে পারে পুষ্টির নিশ্চয়তা

করোনা-পরবর্তী খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। করোনা আমাদের শিখিয়েছে পুষ্টিকর ও রোগ-প্রতিরোধী খাদ্য আমাদের জন্য কতটা জরুরি। করোনাকালীন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ হ্রাস পেয়েছে যা সুস্থতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে শিশুর স্বাস্থ্যের ওপর।

দেশে এখনো অপুষ্টিতে ভোগা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অনেক বেশি। তাই পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে মানুষের সচেতনতা আরো বাড়ানো দরকার। কম খরচে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং এর উপকারিতা বা কোন কোন ফলে কি রকম পুষ্টি রয়েছে তা জনসম্মূখে তুলে ধরা সংশ্লিষ্ট বিভাগের ওপর দায়িত্ব বর্তায়। অপ্রচলিত ফলে পুষ্টিমান যেমন রয়েছে তেমনি রোগ-প্রতিরোধী ক্ষমতাও অনন্য।

কৃষির প্রযুক্তিগত প্রসারের কারণে বাজারে হরেক-রকম ফল পাওয়া যায়। তবে অপ্রচলিত ফলের চাইতে প্রচলিত ফলই বেশি। এক সময় গ্রামে পানিফল (চট্টগ্রামের ভাষায় পাইন্নাগুলা), কালোজাম, পুতিজাম, ডেউয়া, আমলকী, জলপাইসহ বহুরকমের অপ্রচলিত ফলের প্রাচুর্য্য ছিলো। কালক্রমে এসব ফল হারিয়ে যাচ্ছে বা কম চাষ হচ্ছে। কিন্তু এসবের কদর রয়েই গেছে। তাইতো এসব ফল বাজারে উঠতে দেখলে কেনার জন্য বহু মানুষের আকর্ষণ বেড়ে যায়।

এ থেকে বোঝা যায় এসব অপ্রচলিত ফলের প্রতি মানুষের সুপ্ত চাহিদা কত বেশি। দামও কম না। এসব ফলের আবাদ বৃদ্ধি করা গেলে কৃষকও লাভবান হবে। যেমন: এক কেজি ভালো মানের আম ৫০-৬০ টাকায় পাওয়া যায় অথচ এক কেজি আমলকীর দাম বাজারে ১৬০ টাকা, কালোজামের দাম ৮০-১০০ টাকা। অপ্রচলিত ফলের উৎপাদন বাড়ানো গেলে এর সহজলভ্যতা বাড়বে এবং দামও সহনীয় পর্যায়ে আসবে।

মাননীয় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, এমপি কৃষিকে লাভজনক করতে প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফল আবাদে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

তিনি পাহাড়ে কাজুবাদাম, কফি, গোলমরিচসহ অপ্রচলিত অর্থকরী ফসল চাষের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন অপ্রচলিত ফসলের চাহিদা শুধু দেশে নয়, আর্ন্তজাতিক বাজারেও এসবের বিশাল চাহিদা রয়েছে, দামও বেশি পাওয়া যায়। তিনি এসব ফসলের চাষাবাদ বাড়িয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ এর সুযোগ বাড়ানোর উপরও জোর তাগিদ দেন। দেশের পাহাড়ি এলাকায় এসব অপ্রচলিত ফসল চাষের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রার মানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। একইসাথে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে। সে জন্য্য সরকারি সহায়তা অব্যহত থাকবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।

হারিয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা বা অবলুপ্ত হওয়া অনেক জনপ্রিয় ফল বা ফসল আমাদের চারপাশে অনাদরে অবহেলায় প্রকৃতির ছোঁয়ায় বনে জঙ্গলে বেড়ে উঠছে। এরকম শতশত অপ্রচলিত ফল পাহাড়ের বন জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। পাহাড়িরা অপ্রচলিত ফল গাছ বাড়ির আঙ্গিনায় লাগাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। যেমন প্রায় বাড়ির সামনে বা পিছনে তেঁতুল গাছ, বেল গাছ ও আমলকি গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এসব গাছ লাগানোর খরচ নাই বললেই চলে। প্রকৃতির নিয়মেই এরা বেড়ে উঠে। ফলনও নেহায়েত কম হয় না।

কৃষিকে লাভজনক করতে হলে প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফসলের সমন্বয় ঘটাতে হবে। তাতে সারাবছর ধরে পুষ্টির চাহিদা মিটবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। তার জন্য এসব অপ্রচলিত ফসলকে গবেষণার মুলধারায় নিয়ে এসে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে আবার তাদের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে।

দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে প্রায় ৭০ ধরনের ফল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে যা অপ্রচলিত ফল নামে পরিচিত। অপ্রচলিত মানে এসব ফলের অস্থিত্ব আছে, খুঁজলে পাওয়া যায় কিন্তু যখন তখন দেখা যায় না, দেশের সব এলাকাতে জন্মে না, কোনো কোনো এলাকাতে স্বল্প পরিসরে জন্মে আবার কোন জায়গায় বেশি। তবে বেশিভাগ পার্বত্যঞ্চলে বনে জঙ্গলে অনাদরে ও অবহেলায় প্রকৃতির নিয়মেই বেড়ে ওঠে। এরা অবহেলিত হলেও গুরুত্বহীন নয়। পুষ্টিগুণের পাশাপাশি রোগব্যাধি আরোগ্যের ক্ষেত্রে এদের জুড়ি মেলা ভার। পাহাড়ি কৃষকেরা পথ্য হিসাবে এসব ব্যবহার করে বেশি।

অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রাঙ্গামাটি অঞ্চল তথ্যমতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৪৩ রকমের ফলের মধ্যে ২৭ রকম ফলই অপ্রচলিত যা ২০১৯-২০ সালে ১১ হাজার ৫৮৭ হেক্টর এলাকা জুড়ে আবাদ হয়েছিল, যার মোট উৎপাদন ছিলো ৩ লক্ষ ১৮ হাজার ৭৭৬ মেট্রিক টন। এসব ফলের মধ্যে কাজুবাদাম, কফি, কামরাঙা, আমলকি, তেঁতুল, লটকন, বেল, কদবেল, পাহাড়ি বাতাবিলেবু, কালোজাম, পুঁতি জাম, দেশি গাব, চালতা, করমচা, জলপাই, তাল, ডেউয়া, খেজুর, জামরুল, দেশি আমড়া, অরবরই, সাতকরা, গোলাপজাম, কাউফল, বিলিম্বি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব ফলের বংশগতি বিভিন্নতা ও জীববৈচিত্র্যতা যত বেশি থাকবে পরিবেশ সুরক্ষাও হবে তত বেশি।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বেশ কিছু অপ্রচলিত ফলের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। তার মধ্যে বারি আমলকি-১, বারি মিষ্টি তেতুঁল-১, বারি কামরাঙ্গা-১, বারি জলপাই-১, বারি বিলাতি গাব-১, বারি সাতকরা-১, বারি লটকন-১, বারি বেল-১, বারি কতবেল-১, বারি আশঁফল-১,২, বারি জামরুল-১, ২, ৩ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ ৮টি অপ্রচলিত ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে বলে জানা যায়। এসব জাতসমূহ মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক বিস্তার ঘটানো দরকার। তারজন্য স্থানীয় নার্সারীতে এসব ফলের চারা/কলম সহজলভ্য করা প্রয়োজন। সারাবছর ধরে পুষ্টির নিশ্চয়তা প্রাপ্তির জন্য প্রচলিত ফলের পাশাপাশি অপ্রচলিত ফলের আবাদ বাড়ানো দরকার। হারিয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে থাকা অপ্রচলিত ফলগুলো উচ্চ ফলনশীল জাতে রুপান্তরিত হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক এবং প্রচলিত ফসল হিসাবে বাণিজ্যিক চাষাবাদে রুপলাভ করুক সে প্রত্যাশা করছি।

লেখক: মো. জামাল উদ্দিন কৃষি অর্থনীতিবিদ; সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট, এফএও; ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

পাঠকের মতামত: