কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

উখিয়ায় যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যতায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধু পূর্ণিমা উদযাপন

 

শাহেদ হোছাইন মুবিন, উখিয়া:
যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উখিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম ধর্মাবলম্বীরা উদযাপন করছে মধু পূর্ণিমা।

সোমবার ( ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১ ) সকাল থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষেরা উখিয়া কেন্দ্রীয় আনন্দ ভবন বৌদ্ধ বিহার সহ বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে বিহারে প্রার্থনার জন্য জড়ো হতে থাকে।
এসময় শত শত বৌদ্ধ নর-নারী বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধুর পাশাপাশি বিভিন্ন ফলমূল, মধুমিশ্রিত পায়েস ও খাবার দান করেন এবং সকলের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন।

বিকেলে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে দান ও হাজার প্রদীপ প্রজ্জলনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে।

এদিকে পূজারীরা বুদ্ধকে পূজা ও অষ্ঠশীল গ্রহণ করেছে।

বহু বছর আগে এ পূর্ণিমাতে বুনো হাতি বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে ধ্যানরত বুদ্ধকে দান করতে দেখে বনের বানরও মৌচাকের মধু সংগ্রহ করে দানে মগ্ন হয়। এ ঘটনাকে স্মরণ করেই প্রতি বছরের ভাদ্র মাসের পূর্ণিমার এ তিথিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মধু পূর্ণিমা উদযাপন করে থাকেন।

 

বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও শীল গ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মদান এবং প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করেছেন এছাড়া বর্ষাবাস কে ঘিরে তারাও নিয়েছেন আলাদা ব্রত।

বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য এটি একটি স্মরণীয় তিথি। বৌদ্ধ পঞ্জিকায় ভাদ্র পূর্ণিমাকে মধু পূর্ণিমা নামে অভিহিত করা হয়। এ পূর্ণিমা তিথিতে বানর কর্তৃক ভগবান বুদ্ধকে মধুদানের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা জড়িয়ে আছে। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এটি সংগঠিত হয়েছিল বলেই এর ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। বানরের মধুদান একটি নিছক ঘটনা বলে মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে তির্যক প্রাণীর বুদ্ধ ভক্তি এবং দান, সেবা ও ত্যাগের একটি পরম শিক্ষা।

মধু পূর্ণিমার ঘটনায় বলা যায়, এক সময় ভগবান বুদ্ধ দশম বর্ষাব্রত পারিলেয়্য রক্ষিত বনে অধিষ্ঠান করেছিলেন। কৌশাম্বীর ঘোষিতা রামের দু’জন পণ্ডিত ভিক্ষুদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি বিনয় বিধান নিয়ে ভিক্ষুসংঘ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়লে তথাগত বুদ্ধ একক বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে পারিলেয়্য বনে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। সেদিন বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন, অজ্ঞানীদের সঙ্গে বসবাস সুখকর নয় এবং বংশমর্যাদা মানুষকে হীন স্তরে নিয়ে যায়। বুদ্ধ পারিলেয়্য বনে ভদ্রশাল বৃক্ষমূলে রক্ষিত বনসন্ডে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান শুরু করলে দলছিন্ন এক হস্তী বুদ্ধকে সেবা করেছিল। ওই হস্তী ছিল বুদ্ধভক্ত। প্রতিদিন শুঁড়ে বহন করে ওই হস্তী বুদ্ধকে জল এনে দিত, বুদ্ধের সেবা-যত্ন করত, ফলমূল এনে দিত এবং বুদ্ধ পিণ্ডপাত সংগ্রহ করতে গেলে তাকে আগু বাড়িয়ে দিত। এমনকি হিংস্র প্রাণীর উৎপাত ও আক্রমণ থেকে বুদ্ধকে রক্ষা করত, পাহারা দিত। ভগবান বুদ্ধ প্রাণীদের প্রতি অসীম ও অপ্রমেয় মৈত্রী প্রভাবে নিরাপদে ওই বনে বসবাস করতে পেরেছিলেন। বনে অন্যান্য পশু-পাখিও বুদ্ধকে নানাভাবে সেবা-যত্ন করত। বুদ্ধের মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা বলে এটি সম্ভব হয়েছিল। মৈত্রীগুণে প্রাণীরা নত হয়, প্রভুভক্ত হয়। বোধিস্বত্ব ও বুদ্ধজীবনেই এটি একমাত্র সম্ভব; সাধারণ জীবনে নয়। কারণ আমাদের চিত্ত প্রতি মুহূর্তে হিংসা-বিদ্বেষে এবং ক্রোধ ও মোহাগ্নিতে জ্বলছে, নানা পাপ-পঙ্কিলতায় চিত্ত পরিপূর্ণ রয়েছে। ওই চিত্তে কখনও ধ্যান-সমাধি হয় না এবং প্রাণীদের মৈত্রীদান করা ও বশীভূত করাও সম্ভব নয়। কারণ হিংসা দিয়ে হিংসাকে কখনও প্রশমিত করা যায় না, অহিংসা বা অবৈরিতা দিয়েই হিংসাকে প্রশমিত করতে হয়। এটাই জগতের নিয়ম। পারিলেয়্য বনে বুদ্ধ সেটাই প্রমাণ করেছিলেন।

অবশেষে বুদ্ধের বর্ষাবাসের দু’মাস অতিবাহিত হলে পারিলেয়্য বনের এক বানর মৌচাক এনে বুদ্ধকে দান করেন। সেদিন ছিল ভাদ্র পূর্ণিমা। পূর্ণিমার আলোতে সারা বন আলোকিত হয়েছিল। এজন্যই এ পূর্ণিমা তিথিটি বৌদ্ধ ইতিহাসে ‘মধু পূর্ণিমা’ নামে অভিহিত। বনের তির্যক প্রাণীর এসব উদারতা, মহত্ত্ব এবং দান, সেবা ও ত্যাগের মহিমা ও শিক্ষা আমাদের জন্য অনুকরণীয়। বুদ্ধ বানরের সেই মৌচাক দান সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন এবং ওই আনন্দে বানর আন্মহারা ও পরম সুখের উল্লাসে সেদিন মৃত্যুবরণ করে। ওই দানের প্রভাবে মৃত্যুর পর বানর দেবপুত্ররূপে তুষিত স্বর্গে জন্মগ্রহণ করে। তাই তো শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কর্ম বিপাক সৃষ্টি করে, আবার বিপাকই কর্ম সৃষ্টি করে। এ নীতিতে জীবনের পাঁচটি নিয়ম প্রবর্তিত হয়; যথা কর্ম নিয়ম ,বীজ নিয়ম, ধর্ম নিয়ম, ঋতু নিয়ম ও চিত্ত নিয়ম। এ পাঁচটি নিয়মের সমন্বয়ে জীবের দেহ সংগঠিত হয়।

পাঠকের মতামত: