কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

এক ডজন সন্ত্রাসী গ্রুপ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

মাস্টার মুন্না বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সন্ত্রাসী এই গ্রুপ চায় আশপাশের অনিবন্ধিত কয়েকটি ক্যাম্পেও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে। এ নিয়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আরও কয়েকটি গ্রুপ আনাস-মাহাদ, সেলিম-আলম বাহিনীর সঙ্গে মুন্না বাহিনীর বিরোধ চলছে দুই মাস ধরে।

ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ। আধিপত্য বিস্তার এবং অবৈধ আয়ের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সংঘাত হচ্ছে এসব সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে। সর্বশেষ গত রোববার দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছে দুই রোহিঙ্গা, আহত হয়েছে অন্তত ১৫ জন।

কুতুপালং ক্যাম্পে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এপিবিএন ইন্সপেক্টর ইয়াছিন ফারুক জানান, নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপের সঙ্গে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি গ্রুপের বিরোধ দীর্ঘদিনের। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।

পুলিশের তথ্য মতে, গত এক বছরে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ক্যাম্পে নিহত হয়েছে ৪৬ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ২৩ জন। নিহতদের প্রায় সবাই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। এরা ইয়াবা ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে জড়িত।

টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া এলাকার পাহাড়ে রয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আবদুল হাকিম ওরফে হাকিম ডাকাতের গোপন আস্তানা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তালিকাভুক্ত এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে চাকমারকুল ক্যাম্প-২১ থেকে ক্যাম্প-২৭ জাদিমুরা পর্যন্ত সাতটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। তার কথাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অঘোষিত আইন। খুন থেকে গুম, মাদক পাচার থেকে আদম পাচার এমন কোনো অপরাধ নেই হাকিম ডাকাত ও তার লোকজন করে না। টেকনাফের আলোচিত নুরুল কবির হত্যা, সিএনজি ড্রাইভার মো. আলী হত্যা, নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বার ও মুন্ডি সেলিম হত্যা, আবদুল হাফিজ ও তোফায়েল হত্যাসহ অনেক হত্যা মামলার আসামি এই হাকিম ডাকাত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনেকবার অভিযান পরিচালনা করেও পারেনি হাকিম ডাকাতকে ধরতে। তবে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে তার দুই ভাইসহ বাহিনীর নয় সদস্য।

শুধু হাকিম ডাকাত, মাস্টার মুন্না বা আনাস-মাহাদ নয়- এরকম এক ডজন সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। টেকনাফের নয়াপাড়া আনসার ক্যাম্পে হামলা করে আনসার কমান্ডারকে খুন এবং অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটিয়েছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুরে আলম বাহিনী। তাকে আটক করে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করে র‌্যাব। পরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় নুরে আলম। একাধিক সূত্রমতে, নুরে আলম বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জকির আহমদ। সেলিম বাহিনী নামে আরেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছে কয়েকটি ক্যাম্প।

হাকিম ডাকাত, জকির, সেলিম ও মুন্না গ্রুপের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে গত ছয় মাসে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে র‌্যাব। এসব অভিযানে ব্যবহার করা হয়েছে ড্রোন থেকে হেলিকপ্টার। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি আস্তানা। কিন্তু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের শীর্ষ কাউকে ধরা যায়নি।

একটি সূত্রমতে, র‌্যাবের অভিযানে পাহাড়ে বেশ কিছু আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর হাকিম ডাকাত এখন কুতুপালং এলাকায় আত্মগোপন করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

টেকনাফে র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের শীর্ষ কাউকে আটক করা না গেলেও সাম্প্রতিক অভিযানে অনেক সাফল্য এসেছে। অনেক তথ্যউপাত্ত পাওয়া গেছে। তিনি জানান, অভিযানে ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের বেশ কিছু আস্তানা শনাক্ত করার পর সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উখিয়া টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বিশাল এই রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে পরিচালিত করার মতো কোনো সংগঠন অথবা নেতৃত্ব তাদের মধ্যে নেই। কিছু ক্যাম্প মাঝি এবং হেড মাঝিরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে বেশির ভাগ ক্যাম্পে কর্তৃত্ব করছে সন্ত্রাসী গ্রুপ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যাবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে তারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী হতে বাধ্য করছে।

সাধারণ রোহিঙ্গারা বলেন, সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতে পারে না। ক্যাম্পে গত এক বছরে অর্ধশত খুন হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছিল।
উখিয়ার বালুখালী ১১নং ক্যাম্পের হেড মাঝি ছিলেন আরিফ উল্লাহ। জনপ্রিয় এই রোহিঙ্গা নেতা মনে করতেন, রোহিঙ্গারা নিজ দেশে না থাকলে কোনোদিন তাদের অধিকার আদায় হবে না। প্রত্যাবাসনবিরোধী সন্ত্রাসীরা তাকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা এই বার্তা দেয়, কেউ প্রত্যাবাসনের কথা বললে পরিণতি এমন নির্মম হবে।

কুতুপালং ই-ব্লকের এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন কিছু লোক এখানে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর নজরদারি রাখে। তারাই সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে জড়িত। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গাদের ভাসানটেকে না যাওয়ার জন্যও প্রচার চালাচ্ছে।

কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা নুর বশর জানান, মাস্টার মুন্না, হাফেজ জাবের, আনাস, ইসলাম মাহমুদ, সেলিম, সাইফুসহ আরও কয়েকজন সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও ক্যাম্পে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এরা বিপুল টাকা আয় করছে। এ নিয়ে বিরোধেও জড়িয়ে পড়ছে এসব গ্রুপ।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলছেন একই কথা। উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘দিনের আলোয় যেমন-তেমন, রাত হলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নানা অপরাধ করলেও তাদের পুলিশে দেওয়া যায় না।’
কক্সবাজারে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসুদৌজ্জা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্তিত্ব রয়েছে। নানা সমস্যার মধ্যে থাকলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে সামলানো কঠিন। তবে তারা এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গারা ততই অপরাধ ও মাদকপ্রবণ হয়ে উঠছে। গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগে শতাধিক মামলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার অজুহাতে দেশটির সেনাবাহিনী দমন অভিযানে নেমে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। প্রাণ বাঁচাতে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। সমকাল

পাঠকের মতামত: