কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

কে শুনবে সেন্টমার্টিনের কান্না

দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে দিন দিন বাড়ছে পর্যটকের ঢল। দ্বীপের বুক খুঁড়ে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত-অনুমোদনহীন হোটেল, মোটেল, কটেজ, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা। এতে কমছে দ্বীপের বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। বাড়ছে দূষণ। ফলে প্রবালসহ জীববৈচিত্র বিপন্ন হতে চলেছে। শ্রীহীন হয়ে পড়ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যন্য এ দ্বীপটি। অন্যদিকে, অব্যাহত ভাঙনে ক্রমশঃ ছোট হয়ে পড়ছে দ্বীপের আয়তন। এমন দুর্দশায় নীরব কান্না চলছে সেন্টমার্টিনজুড়ে।

সেন্টমার্টিন কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগরবক্ষে বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে গ্রাম আছে ৯টি। সরকারি তথ্যে দ্বীপের আয়তন ১৩ বর্গকিলোমিটার উল্লেখ রয়েছে। তবে বাস্তবে প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার।

প্রতিবছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে শুরু করে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত এই দ্বীপে বেড়াতে যান পর্যটকেরা। এ সময় পর্যটকের ঢল নামে। জানা যায়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ হতে প্রায় ১১টি জাহাজ এবং স্পিডর্বোড, ইঞ্জিন নৌকায় করে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭ হাজার পর্যটকের পা পড়ে এখানে। স্থানীয় দ্বীপবাসীর সংখ্যা এখন ১০ হাজার। অথচ এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯৬-১৯৯৭ সময়ে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যেতেন বছরে ২০০ জনের কম। একই সময়কালে (৯৬-৯৭ সাল) সেখানে জনসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭০০ জন। পর্যটক বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্বীপের বুক খুঁড়ে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠছে হোটেল, মোটেল, কটেজ, রেস্তোরাঁসহ নানা স্থাপনা।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ নুর আহমেদ জানান, বতর্মানে এখানে ছোট বড় মিলিয়ে হোটেল মোটেল, কটেজ আছে ১৪৪টি। খাবার হোটেল আছে প্রায় ১৫০টি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১২ সালে সেন্টমার্টিনে মাত্র ১৭টি হোটেল ছিল।

জানা যায, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বহিরাগত বিত্তশালীরা স্থানীয়দের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের ভূমি কিনে নিয়ে হোটেল মোটেল কটেজ নির্মাণ করছেন। এসব নির্মাণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। এছাড়া এগুলোর কোন অনুমোদনও নেই। অন্যদিকে, অভাবের তাড়নায় নগদ টাকা পেয়ে নিজের বসতভিটা-জমি বিক্রি করে ভূমিহীন হয়ে পড়ছে দ্বীপবাসী।

এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ নুর আহমেদ বলেন, বিত্তশালীরা অসহায় লোকজদের চাকরিসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ভূ-সম্পদ হাতিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে চলতে থাকলে দ্বীপের সবাই এক সময় ভূমিহীন হয়ে নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়বে। তিনি আরও জানান, দ্বীপের চারিদিকে সমুদ্রের তীরঘেঁষে একসময় বেড়িঁবাধের মত উঁচুডিবি ছিল। এতে প্লাবন বা জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের জল দ্বীপে ডুকতে পারতো না। এখন এ উঁচুডিবি কেটে সমুদ্রের তীরঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে হোটেল, মোটেল, কটেজগুলো। এছাড়া এসব স্থাপনা নির্মাণের জন্য বনবাদাড়ও কেটে ফেলা হচ্ছে।

সৈকতসংলগ্ন এলাকার এসব  হোটেল-মোটেল ও দ্বীপজুড়ে অবস্থিত রেস্তোরাঁগুলোর কোনোটিরই নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। পর্যটকদের মলমূত্র, উচ্ছিষ্ট, পানির বোতল এসব দ্বীপের যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। এভাবে দ্বীপটি আস্তে আস্তে একটি ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। রান্নার ও অন্যান্য বর্জ্য দ্বীপে ও সাগরে ফেলা হয়। রেস্তোরাঁগুলোর রান্নার চুলার ধোঁয়া এবং বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটর ব্যবহার করায় বিকট শব্দ, দ্বীপবাসী আর পর্যটকদের মলমূত্র ও অন্যান্য বর্জ্যরে কারণে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে সমুদ্রের জল এবং দ্বীপের পরিবেশ। এতে বিপন্ন হচ্ছে জীব বৈচিত্র।

জানা যায়, বাংলাদেশে এখন শুধু এ দ্বীপে ধূসর বক আর জীবন্ত প্রবাল টিকে আছে। জীবন্ত প্রবাল আছে দ্বীপের  দক্ষিণের ছেঁড়া দ্বীপ অংশে। অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক ও দূষণের কারণে প্রবাল, বিরল প্রজাতির কচ্ছপসহ প্রাণীরা বিপন্ন।

ক্রমাগত ভাঙনে হুমকিতে পড়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। সমুদ্রের ¯্রােতে প্রতিনিয়ত ভাঙছে পাড়, ছোট হচ্ছে আয়তন। আসছে বর্ষায় এ ভাঙন আরও তীব্র হওয়ার শঙ্কা স্থানীয়দের। তারা জানান,  প্রত্যেক বছর বর্ষা মৌসুম এলেই ভাঙন শুরু হয়। ভাঙন রোধের জন্য জিও ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল অনেক আগে। তাও এখন নষ্ট হয়ে গেছে।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ বলেন, ১৫ বছর ধরে ভাঙন অব্যাহত আছে। ৮৬২ একর ৩৩ শতাংশ জমির মধ্যে ইতোমধ্যে দ্বীপের উত্তর পশ্চিম পাশে প্রায় ১০০ একর বিলীন হয়ে গেছে । ভাঙন যদি এভাবে অব্যাহত থাকে এবং  ভাঙন রোধে সরকার যদি কোনও ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে  আগামী ২০-২৫ বছর পর এই দ্বীপ বিলীন হওয়ার আশংকা রয়েছে। পূর্বকোণ

পাঠকের মতামত: