কক্সবাজার, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাঁকখালী নদীর পানিকে ধানি জমি দেখিয়ে ১০ কোটি টাকা ঋণ!

শাহজাহান চৌধুরী শাহীন, কক্সবাজার::

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর পানিকে ধানি জমি দেখিয়ে উত্তরা ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক কক্সবাজার শাখা থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এইচএম এন আলম নামের এক ব্যক্তি। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে দুদকের তদন্তে। এসব জমি পানির নিচে হলেও ধানি জমি দেখানো নিয়ে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়েছে। ভুয়া দলিলের ঋণ জালিয়াতি ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি আর ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের তদারকি কাজে আসছে না। ব্যাংক ঋণের বিপরীতে গ্রাহকদের জমা দেওয়া মর্টগেজের সিংহভাগ দলিলপত্রের জমি ভুঁয়া ও অস্তিত্ববিহীন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এসব জাল-জালিয়াতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কর্মচারী জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার সদর ও রামুতে জমি নিয়ে জাল-জালিয়াতির উৎসব চলছে। ভুয়া খতিয়ান দিয়ে আমোক্তার নামায় জমি রেজিঃ নিয়ে ভয়ঙ্কর প্রতারণায় নেমেছে চক্রটি। কখনো ভুয়াদাতায়, কখনো জমির মালিককে না জানিয়েই জাল দলিল করছে তারা। পরবর্তী সময়ে ওই দলিল জামানত রেখেই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের ঋণ নেওয়া হচ্ছে। এধরনের জালিয়াত চক্রের সন্ধান পেয়েছে দুদক। কক্সবাজারের রামু-চাকমারকুল এলাকার নুর আহম্মদ সিকদারের ছেলে এইচএম নুরুল আলম রেজিঃ অফেরত যোগ্য আমোক্তার নামা দেখিয়ে শহরের বাকখালী নদীর পানির মধ্যে জমি কিনেছে ২২ কোটি ৩৬ লাখ ৫ হাজার টাকায়। যার দলিল নং-৪৬৪৫/২০১৫। ধানী জমি দেখিয়ে উত্তরা ব্যাংক থেকে ৫ কোটি ৫০ লাখ ও জনতা ব্যাংক কক্সবাজার শাখা থেকে ৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যে জমি দিয়ে ব্যাংক ঋণ নেয়া হয়েছে, সেই জমির দুই তৃতীয়াংশ বাঁকখালী নদীর পানির নিচে এবং জমির অস্থিত্বও নেই। দুটি ব্যাংকের ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা এখন বাঁকখালীর নদীর জলে। ২০১৫ সালে সাড়ে ২২ কোটি টাকা দিয়ে কেনা জমির টাকার উৎস নিয়েও তদন্ত করছে দুদক।

দুদক সূত্র জানান, বাঁকখালী নদীর প্রায় ৫০০ একর জমি দখল করেছেন ১৫৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। তারই অংশ হিসেবে বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল সেতু সংলগ্ন প্রায় ২ একর জায়গা দখল করার অভিযোগে এইচএম এন আলমের বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু করে।

সুত্র মতে, গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রাথমিকভাবে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক নোটিশের মাধ্যমে তাকে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ তলব করা হয়। নোটিশে পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি চাওয়ার পাশাপশি এইচএম এন আলমকে ২১ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় নদীর তীরের সত্ত্ব সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র এবং এ বিষয়ে কোনও মামলা কিংবা রায় হয়ে থাকলে তার রেকর্ডপত্র নিয়ে হাজির হতে অনুরোধ করা হয়। নির্ধারিত সময়ে তিনি হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানে ব্যর্থ হলে ‘অভিযোগ সংক্রান্ত তার কোনও বক্তব্য নেই’ বলে গণ্য করা হবে।

এদিকে, একই এক চিঠিতে উত্তরা ব্যাংক কক্সবাজার শাখার কাছে এইচএম এন আলমের আর্থিক লেনদেন ও ঋণ দিয়ে থাকলে তার সত্যায়িত কপি চেয়েছে দুদক। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন।

দুদক সুত্রে জানা গেছে, এইচএম এন আলম ২০ সেপ্টেম্বর দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এ হাজির হয়ে তার হিসাব বিবরণী জমা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি দুদক। তা নিবিড় তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দিন। উত্তরা ব্যাংক কক্সবাজার শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, দুদক থেকে যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা প্রেরণ করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার ঝিলংজা মৌজার কলাতলীতেও পাঁচ কোটি টাকার সম্পদ অফেরতযোগ্য আমমোক্তার নামা মুলে রেজিস্ট্রার করেন কক্সবাজার সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে। গত ৫/২/২০২০ ইং এই আমোক্তারনামা রেজিঃ দলিল নং-৫২২ সম্পাদন করা হয়। এতে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করা হয়েছে ৯৫ লাখ টাকা। ঝিলংজা মৌজার বাকখালী নদীও একই ভাবে সাবকবলা রেজিস্ট্রি না করে অফেরতযোগ্য আমোক্তার নামা সম্পাদন করে (দলিল নং-৪৬৪৫/২০১৫, তাং-২৩/১২/২০১৫) সরকারকে ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা রাজস্ব হতে বঞ্চিত করেছে। সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশেই রাজস্ব বঞ্চিত করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এসব জমি ও টাকার বিপরীতে বিপুল পরিমাণ আয়করও ফাঁকি দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে এ ধরনের আরও শতাধিক দলিল সম্পাদনের খদিস পাওয়া রামু সাব রেজিষ্ট্রি অফিস ও কক্সবাজার সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে। এসব সম্পদের মুল্য কয়েকশত কোটি টাকা। গত ২০০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এসব সাব কবলা দলিল ও আমোক্তারনামা দলিলগুলো সম্পাদন করা হয়। মূলত সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার জন্য অফেরতযোগ্য আমোক্তারনামার গল্প সাজিয়ে আমোক্তার নামার সেই দলিল ব্যাংককে মর্গেজ রেখে মোটা অংকের ঋণ নেয়াই তার মুল রহস্য।

ব্যাংক সূত্র জানায়, নদীর জমি মরগেজ রেখে এইচএম এন আলমকে উত্তরা ব্যাংক ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও জনতা ব্যাংক ৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। একইভাবে দলিল দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হচ্ছে অন্যান্য ব্যাংক থেকেও। সম্পূর্ণ ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রামু সাব রেজিঃ অফিসে রেজিকৃত দলিল নম্বর ২২৮১ ও ২২৮২ দলিল নম্বর ১৬৭৫ ও ১৬৭৬ উত্তরা ব্যাংকে মরগেজ দিয়ে নেয়া হয় আরো ৪ কোটি টাকা। উত্তরা ও জনতা ব্যাংকে অস্তিত্ববিহীন জমির সম্পূর্ণ ভুয়া দলিল, আমোক্তার নামা দলিল মরগেজ দিয়ে ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকে ওই ব্যবসায়ীর কাছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই দুষ্কর্মের সঙ্গে ওই ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত বলে সুত্রে প্রকাশ।

এব্যাপারে এইচএম নুরুল আলমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দুদক চিঠি দিয়েছে, তা জবাব দিয়েছি। ব্যাংক আমাকে যে ঋণ দিচ্ছে তা সম্পত্তির অনুকুলে দিচ্ছে। বাঁকখালী নদীর ধানি জমির বিষয়ে তিনি বলেন, জমিগুলো একসময় ধানি ছিল, আস্তে আস্তে বাঁকখালী নদীর গর্ভে চলে গেছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এইচ এম এন আলম সদরের ১১৩৩৪ নং এর একটি ভুয়া খতিয়ানে জমি আমোক্তার নাম নিয়ে সেই জমি ‘বন্ধক’ রেখেও ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছে বলে অভিযোগ। অবশ্য ভুয়া খতিয়ানটি সহকারী কমিশনার (কক্সবাজার সদর) অফিস স্থগিত করে দিলেও ঋণের বন্ধকী সম্পত্তি হিসেবে ওই জমি ‘বন্ধক’ রাখা হয়। কিন্তু জমির কথিত মালিক ঋণের গ্রাহক এইচএম এন আলমের অনুকূলে ওই জমির নামজারি হয়নি। এন আলম কয়েক বছর ব্যাংকের সঙ্গে স্বাভাবিক লেনদেন করে ভুয়া জমির ও স্থায়ী সম্পদ মর্টগেজ দেখিয়ে অর্ধশত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করবে কিনা তা নিয়েও শংকা দেখা দিয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, যেসব জমাকৃত দলিলপত্রে যেই জমির আকার ও বিবরণ রয়েছে বাস্তবে সেই জমি অস্তিত্বহীন এবং যেই ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া হলো, ঠিকানায় গিয়ে ব্যক্তির নামে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনকি মর্টগেজ হিসেবে নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট উত্তরা ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক ওইসব জমিতে দায়বদ্ধতার সানইবোর্ড দেয়নি। ফলে একই জমি দেখিয়ে বারবার ঋণ জালিয়াতি করার সুযোগ পায় প্রতারক এইচএম এন আলম। এর ফলে ভুয়া জামানত বা একই দলিল দেখিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়া বন্ধ হচ্ছে না।

সরকারি একটি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আগে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার সময় শুধু দেখত ঋণগ্রহীতা খেলাপি কিনা। এতে জাল বা ভুয়া দলিল দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেওয়া ঠেকানো যাচ্ছিল না। এমনকি দলিল ঠিক হলেও একই দলিল দিয়ে একাধিক ব্যাংক থেকে অসত্য তথ্য দিয়ে ঋণ নেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এখন ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, তারা যাতে খেলাপি ঋণের তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা যে সম্পদ জামানত হিসেবে দেবে তার দাগ নম্বও, পজিশন ও খতিয়ানসংক্রান্ত তথ্যও যেন সংগ্রহ করা হয়।

পাঠকের মতামত: