কক্সবাজার, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

ভাসানচর পরিদর্শনে যাবে রোহিঙ্গা নেতারা

আবদুর রহমান, টেকনাফ::

ঈদের পর কক্সবাজার থেকে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা প্রতিনিধিকে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারা। বর্তমান কক্সবাজারের ঘিঞ্চি শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ওই দ্বীপে পাঠানোর অংশ হিসেবে এই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

শুক্রবার (৩১ জুলাই) শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আর্মড পুলিশ ১৬ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হেমায়েতুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিনিধি দলে শিবিরগুলোর বিভিন্ন ব্লকের মাঝিরা (নেতারা) থাকবেন। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই ৫০ থেকে ৬০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হতে পারে।

এসপি হেমায়েতুল জানান, ‘রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের ব্যাপারে সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনসহ (আরআরআরসি) দাতা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি কমিটি রয়েছে। সম্প্রতি সেই কমিটির একটি সভায় শিবির থেকে ৫০ থেকে ৬০ জন রোহিঙ্গা নেতার একটি প্রতিনিধি দলকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরিদর্শনের পর রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচরে যাওয়ার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা কক্সবাজারের আশ্রিত শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের ভাসানচর পরির্দশনে মনোনিত প্রতিনিধিদের একটি তালিকা বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে। এই তালিকায় ক্যাম্পের ব্লক মাঝি, সাব মাঝি, হেড মাঝি, লিডার, শিক্ষক ও ইমামদের নাম রয়েছে। অন্যদিকে, মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিকের বেশি রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ইতোমধ্যে দুই কিস্তিতে ভাসানচরে নিয়ে রেখেছে সরকার। আগে থেকেই ভাসানচরে যাওয়ার জন্য সেখানকার ভিডিও চিত্র দেখিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করে আসছে সরকার।

এই উদ্যোগকে ইতিবাচক উল্লেখ করেছেন তালিকায় থাকা টেকনাফের জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি মো. নুর বলেন, ‘ভাসানচর যদি বসবাসের উপযুক্ত হয় তবে অবশ্যই রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে। আমরা স্বচক্ষে দেখে এলে সবাইকে বোঝাতে পারবো। সরকারি লোকজন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। ঈদের পরে ভাসানচরে যাবে ক্যাম্পের একটি প্রতিনিধি দল।

উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ রফিক জানান, কোরবানির পরেই ভাসানচর দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে তাদের। তার ক্যাম্প থেকেও কয়েকজন যাবেন।

আরআরআরসি’র প্রতিনিধি হিসেবে টেকনাফের জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ খালিদ হোসেন বলেন, ‘ভাসানচর পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তার আওতাধীন দুটি ক্যাম্পের কয়েকজন মাঝির নামও ওই তালিকায় রয়েছে।

টেকনাফের লেদা শরণার্থী শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটি মানতে আমরা বাধ্য। তবে রোহিঙ্গাদের কষ্ট হয়, এমন কোনও সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ নেবে না বলেই প্রত্যাশা করি। এই মুহূর্তে পরিষ্কারভাবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চর থেকে ঘুরে এসে হয়তো বলা যাবে সেখানে বাস করা যাবে কিনা।

তিনি আরও বলেন, ‘ভাসানচর পরিদর্শনের বিষয়টি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তালিকায় নাম নেই, কিন্তু স্বেচ্ছায় ভাসানচর পরিদর্শনে ইচ্ছুক, এমন রোহিঙ্গাদেরও নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছি আমরা।

ওই শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সৈয়দ আলম জানান, গত কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পের মাঝিরা প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য বোঝাচ্ছেন। যদি কোনও পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি থাকে, তবে তা বলার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। তবে কাউকে জোর করা হচ্ছে না। যারা ক্যাম্পের বাইরে জমি ভাড়া নিয়ে বাস করছে, তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া উচিত। উখিয়া-টেকনাফে এমন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় এক লাখের কাছাকাছি বলেও দাবি করেন তিনি।

এই বিষয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মুখপাত্র মোস্তফা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘মে মাসের শুরুতে উপকূল ও জলসীমা থেকে উদ্ধার হওয়ার তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই শরণার্থীদের জন্য সেখানে জাতিসংঘের প্রবেশাধিকার এখন খুবই জরুরি। জাতিসংঘ ইতোমধ্যেই সরকারকে জানিয়েছে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে দেখা করে তাদের মানবিক পরিস্থিতি এবং সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন মূল্যায়ন করতে সেখানে সুরক্ষা সফর করার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।

নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) খোরশেদ আলম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের পরে ভাসানচর দেখতে কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল আসার কথা রয়েছে। ঠিক কবে প্রতিনিধি দল আসবেন সে ব্যাপারে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এইটা সত্যিই তিন শতাধিকের বেশি রোহিঙ্গা ভাসানচরে রয়েছে। তারা সবাই ভাল আছেন।

ভাসানচর পরিদর্শনের জন্য রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের তালিকা তৈরির কথা স্বীকার করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখনও তারিখ ঠিক করেনি সরকার।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুসাঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে।

পাঠকের মতামত: