কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

মনসা পূজা আজ

আবীর চক্রবর্তী

খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার অব্দে সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্গত আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মা মনসা দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। পরবর্তীতে পৌরাণিক দেবী হিসেবে তিনি খ্যাত হন। পদ্মপুরাণ, দেবী ভাগবত পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণসহ কয়েকটি উপপুরাণে এই দেবীর পরিচয় পাওয়া যায়।
ইতিহাসবিদদের মতে, মনসা দেবীর পূজার প্রচলন হয় দশম-একাদশ শতকে। সাধারণত সর্পক‚লের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে পূজনীয় হলেও তাঁকে কৃষির দেবীও বলা হয়। পুরাণ মতে, দেবী মনসা জরৎকারু মুনির পতœী, আস্তিকের মাতা এবং বাসুকির ভগিনী। ব্রহ্মার উপদেশে ঋষি কশ্যপ সর্পমন্ত্র সৃষ্টি করেন এবং তাঁর তপস্যার দ্বারা মন থেকে অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে মা মনসার আবির্ভাব হয়।
মন থেকে সাকার রূপ লাভ করেছেন বলে তাঁর নাম হয়েছে ‘মনসা’। মা মনসাকে শিবের কন্যা রূপেও কল্পনা করা হয়। মনসার অপর নাম কেতকা, বিষহরি, পদ্মাবতী প্রভৃতি। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার পর পঞ্চমী তিথিকে (শ্রাবণ) নাগপঞ্চমী বলে। একসময় নাগপঞ্চমীতে উঠোনে সিজগাছ স্থাপন করে মনসা দেবীর পূজা করা হতো। ভাদ্রমাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী পর্যন্ত পূজা করার বিধান আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে একমাস ধরে পূজা অথবা শুধুমাত্র শেষ দিনে পুরোহিত দ্বারা পূজা করা হয়।
নাগক‚ল কশ্যপ মুনির জাত যা সাধারণ সাপ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। যেমন: অনন্ত, শিষ, বাসুকি প্রভৃতি। বিষ্ণুর মস্তকের ওপরে থাকে শিষ নাগ।
বাংলা সাহিত্যে দেবী মনসা : ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে কানা হরি দত্ত রচিত মনসামঙ্গল, নারায়ণ দেবের পদ্মপুরাণ, বিপ্রদাস বিপলাই রচিত মনসা বিজয়, কেতাক দাস, ক্ষেমানন্দসহ ২২জন কবি রচিত দেবী মনসাকে নিয়ে মঙ্গলকাব্য ও পালাগান তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক প্রতিচ্ছবিকে প্রকাশ করে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় ১০ম অধ্যায়ের ২৮-২৯ শ্লোকে বলেছেন, সর্পের মধ্যে বাসুকি, নাগের মধ্যে তিনি অনন্ত।
দেবী মনসার পূজা কালক্রমে বাঙালি সনাতনী সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেরালা, তামিলনাড়–সহ দক্ষিণ ভারতে, নেপালের কাঠমুন্ডুতে নাগপঞ্চমী অন্যতম প্রধান উৎসব। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, বরিশালসহ অনেক আদিবাসী স¤প্রদায়ের পল্লীতেও গড়ে উঠেছে মনসা দেবীর মন্দির।

ছাগবলি প্রথা : ধর্মের নামে পশুবলি ও প্রাণিহত্যার প্রথা বেদ, উপনিষদ, পুরান, চন্ডী, গীতায় উল্লেখ নেই। তবে তা আছে মনুষ্যরচিত কিছু গ্রন্থে। ঋষিরাও এর উপদেশ দেননি। ঈশ্বরকে যদি সন্তুষ্ট করতে হয় তাহলে ফুল বা মিষ্টি দিয়েও করা যায়, পশুর রক্তই নিবেদন করতে হবে এমন কোনও কথা নেই বলে মত পÐিতদের। শত শত বছর আগে রাজারা এই প্রথা চালু করেছিলেন। চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিছু অঞ্চলে মনসা পূজায় ছাগবলি চালু আছে। মহাভারতের অনুশাসন পর্ব, শ্রীমদ্ভাগবত, যজুর্বেদ, অথর্ব বেদ, মনুসংহিতায় প্রাণিহত্যা নিন্দনীয় হিসেবে গণ্য হয়েছে। তবে অনেক শাস্ত্রকার এর অপব্যাখ্যা করে থাকেন।

মূলত, বৈদিক যজ্ঞবিধি অনুসারে পশুবলি দেওয়া হতো। এই বলি মাংসাহারের জন্য নয় বরং জরাগ্রস্ত পশুকে নতুন ও উন্নত জীবন দান করার জন্য। যজ্ঞস্থলে বলিকৃত পশু বৈদিক মন্ত্রশক্তির প্রভাবে পুনরায় উন্নত দেহ লাভ করতো। আমাদের মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়। তাই মনকে বিষমুক্ত করতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনসা পূজা করেন।

পাঠকের মতামত: