কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গারা কি আর ফিরতে পারবে মিয়ানমারে?

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী দেশটি থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারে বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে তারা বসবাস করছে। তাদের মধ্যে কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী স্থানান্তর করা হয়েছে নোয়াখালী দ্বীপ অঞ্চল ভাসানচরে। সেখানে তাদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ সরকার।

কিন্তু এই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কি আর কখনও ফিরতে পারবে মাতৃভূমি মিয়ানমারে?

“আমরা সব সময়ই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। যখন সুযোগ হবে তখনই ফিরে যাব। কিন্তু তার আগে আমাদের সেখানে নিরাপত্তা, বাসস্থান, নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে,” বলেন কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী কমিউিনিটির সহ-সভাপতি মাস্টার আব্দুর রহিম।

এই নিশ্চয়তা কে দেবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সেটার নিশ্চয়তা মিয়ানমার সরকারকে দিতে হবে।

কিন্তু নতুন সামরিক জান্তা সেটা করবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর আরও নির্যাতন বাড়ছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও চাপ সৃষ্টি করতে হবে৷ জাতিসংঘের উদ্যোগ যথেষ্ঠ নয়। ”

বাংলাদেশের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জনিয়ে বলেন, ‘‘আমরা ক্যাম্পে ভালো আছি।

কিন্তু এখানে আমাদের দেয়ালবন্দি কাঁটাতারের মধ্যে জীবন। বাইরে চলাচলের অনুমতি নেই। বছরের পর বছর ধরে একটি জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে যাদের সামনে কোনও ভবিষ্যত নাই। ”

ঠিক এমন এক বাস্তবতায় রবিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস। জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বে বর্তমানে আট কোটি বেশি শরণার্থী বিভিন্ন দেশের আশ্রয়ে রয়েছেন।

যেখানেই তারা থাকুন না কেন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খেলাধুলার মতো বিষয়গুলোতে যাতে তারা অন্তর্ভুক্ত থাকেন সেই আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ বাংলাদেশেও রোহিঙ্গারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

কুতুপালং ক্যাম্পের মুখপাত্র ইউনূস আরমান বলেন, “এখানে আমরা ভালো আছি৷ তবে আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে চাই। অনেক রোহিঙ্গা আছেন যাদের জন্ম এখানে। তারপরও তারা পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন না। ”

শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর তথ্যানুযায়ী, কক্সবাজারের কুতুপালং এখন বিশ্বে সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আট লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছেন সেখানে।

বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের হিসেবে, ভাসানচরসহ কক্সবাজারের ৩৫টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। আর এই ১১ লাখের মধ্যে সাত লাখ মিয়ানমার থেকে আসেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলা ও নির্যাতনের মুখে।

মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার চুক্তি করে ২০১৮ সালে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাট ছয় লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠালেও এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে তারা ফেরত নেয়নি। এরমধ্যে সামারিক জান্তা ক্ষমতা দখল করায় সেই চুক্তি নিয়ে নতুন করে আর কোনও কথা হচ্ছে না।

রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে হতাশা আরও বাড়ছে। মিয়ানমার সরকারের ওপর তাদের এখনও কোনও আস্থা তৈরি হয়নি। এদিকে স্বল্প জায়গায় এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর বসবাসে দেখা দিচ্ছে নানা সমস্যা। কুতুপালং ক্যাম্পের মুখপাত্র ইউনূস আরমান বলেন, ‘‘এখন এখানে ক্যাম্পে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেই কেউ কেউ সন্ত্রাস এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একটি গ্রুপ এখানে বসে মিয়ানমার সরকারের হয়ে কাজ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এখান থেকে তথ্য পাচার করছে৷ যা আমাদের বেকায়দায় ফেলছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছেও আমাদের হেয় করছে। ”

রোহিঙ্গাদের নিয়ে কক্সবাজারের স্থানীয়দের মধ্যেও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হচ্ছে৷ উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হকের দাবি, ‘‘রোহিঙ্গাদের একটি অংশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় নিরাপত্তা সংকট তৈরি হচ্ছে৷ তাদের কেউ কেউ মাদকসহ নানা অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে৷ ফলে স্থানীয়ভাবে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে৷ তাদের মধ্যে নানা গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। ”

শরণার্থী স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ

বাংলাদেশ শরণার্থী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেশনে সই করেনি। ফলে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকারের কাগজে কলমে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘‘শুধু বাংলাদেশ কেন ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার কোনও দেশই সেই শরণার্থী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা শরণার্থীদের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। যারা এই রিফিউজি স্ট্যাটাসের কথা বলছেন তারা ম্যাক্সিকান বর্ডারে শিশুদের আলাদা করে রেখেছে, যা মানবতা বিরোধী। ”

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই মূল সমাধান৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সে ব্যাপারে তেমন কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। চীন ও ভারত তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা তো বাংলাদেশের নয়, সমস্যা হলো মিয়ানমারের। তাদের এটা সমাধান করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টি করা উচিত।

মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শুক্রবার একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। ১১৯টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও, ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ড ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘ওখানে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে তো কিছু নাই। তাহলে বাংলাদেশের স্বার্থ কী? মিয়ানমার তো বাংলাদেশের শত্রু না। ”

এদিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর কারণ ব্যাখ্যা করে একটি বিবৃতিতে দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন যে জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো কথা নাই। সমস্যা সমধানের কোনো উপায়ও প্রস্তাব করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের রাখাইনে যে অত্যাচার চালানো হয়েছে সে ব্যাপারেও কিছু বলা হয়নি। তাদের প্রত্যাবাসন, সেখানে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও প্রস্তাবে কিছু নাই। রোহিঙ্গা সমস্যার কারণ ও তার প্রতিকারের কোনো কথা না থাকায় বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থেকেছে। সূত্র: ডয়েচে ভেলে

পাঠকের মতামত: