কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হচ্ছেটা কী

আবদুর রহিম::

ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। সংঘর্ষ হলেই চলে গুলি। জবাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কা বাড়ছেই। গতকালও দুটি ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রোহিঙ্গাদের একটি ক্যাম্পে দুপক্ষের গোলাগুলিতে একজন নিহতের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়ে ২৫ জন চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে আরেকটি ক্যাম্পে স্থানীয় কিশোর কালুকে জবাই করে হত্যার পর পালিয়ে গেছে রোহিঙ্গা আয়াছ।

মানবিক আশ্রয়ের রোহিঙ্গারা এখন হিংস্রতায় রূপ নিচ্ছে। শরণার্থী উদ্বাস্তুরা আশ্রয়শিবিরে আইন মানছে না। বাইরে কোথাও যেতে হলে ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি নিয়েই যেতে হয়। রোহিঙ্গারা এখন আর সেটি তোয়াক্কা করছে না। ব্যবসা করছে, দোকান খুলে বসেছে। আশ্রিত দেশের মুদ্রা ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে সব ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ওপর চোখ রাখা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওদের অস্বাভাবিক আচরণ বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করছে।

রোহিঙ্গারা এখানে এসেছে ঠিকই তবে তাদেরকে নিয়ে মিয়ানমারের একটা স্বার্থ রয়েছে। তারা সব সময় একটা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের স্বার্থ। সেখানেও কিছু রয়েছে কি-না দেখতে হবে। তৃতীয়টি রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি। এটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবেও দেখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে রেখে প্রশাসনকে আরো নজরদারি বাড়ানোর দাবি উঠেছে।

জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফের চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। নুর হাকিম (২৭) নামে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ২৫ রোহিঙ্গা। নিহত নুর হাকিম টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের চাকমারকুলের ২১ নম্বর ক্যাম্পের সি-ব্লকের বাসিন্দা হোসেন আলীর ছেলে।

১৬ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি তারিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। এরই মধ্যে রোববার ভোররাতে দুইপক্ষ গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে নুর হাকিম নিহত হয়। আহত আরও ২৫ রোহিঙ্গা।

১৬ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক এসপি তারিকুল ইসলাম আরও বলেন, দুইপক্ষের গোলাগুলির খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ২৫ রোহিঙ্গা, তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

টেকনাফের হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নুরে আলম জানান, বর্তমানে পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাসানুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার বিষয়ে পুলিশ সবসময় নজর রাখছে। পুলিশের বিশেষ টিম সেখানে কাজ করছে। সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় মোহাম্মদ ফোরকান প্রকাশ কালু (১৪) নামে এক কিশোরকে গলা কেটে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা কিশোর আয়াছ। গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে উখিয়ার কোটবাজারের ডেকোরেশনের দোকান থেকে এ কিশোরের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত কালু রত্নপালং নিয়নের তেলিপাড়া এলাকার বশির আহমেদের ছেলে। সে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় শাহ আলমের ডেকোরেটর্সের দোকানে কাজ করে আসছিল। দোকান মালিক শাহ আলম বলেন, ‘আয়াছকে আমি চিনি না। তাকে কালুই কাজ করার জন্য এনেছে।

শনিবার রাত ১২টার দিকে তাদের দোকানে রেখে গেছি। সকালে এসে কালুর মরদেহ দেখতে পাই। আয়াছ সেই থেকে পলাতক।’ নিহত কালুর বাবা বশির আহমেদ বলেন, ‘কে বা কারা কেন আমার ছেলেকে হত্যা করেছে এখনো জানি না। সকালে শুনতে পাই আমার ছেলে গলাকাটা অবস্থায় পড়ে আছে। এখন আমি ছেলে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার চাই।

বিষয়টি নিশ্চিত করে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) গাজী সালাউদ্দিন বলেন, ‘খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। কে বা কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ ছাড়াও পুলিশের বিশেষ ইউনিট সিআইডির একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে সব কিছু জানার চেষ্টা করছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বারবার এমন ঘটনা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তো অবশ্যই একটি সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে রয়েছে। আর তাদেরকে প্রতিনিয়ত নজরদারির মধ্যে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তারা যেহেতু একটা জনগোষ্ঠী থেকে নির্যাতিত হয়ে এসেছে এবং একসঙ্গে এতগুলো লোকের বসবাস, স্বাভাবিকভাবে সেখানে কিছু গণ্ডগোল, কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এ ঘটনাগুলোর পেছনে একটা কারণ রয়েছে।

একটা হচ্ছে রোহিঙ্গারারা এখানে এসেছে ঠিকই, তবে তাদেরকে নিয়ে মিয়ানমারের একটা স্বার্থ রয়েছে। তারা সবসময় একটা স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় হচ্ছে রাষ্ট্রের স্বার্থ। সেখানেও কিছু রয়েছে কি-না দেখতে হবে। তৃতীয়টি রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি। এটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবেও দেখা হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে বলবো যে, ঘটনাগুলো ঘটছে এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো বিষয় নেই। তাই বহু সংখ্যক মানুষ যেখানে বসবাস করছে, সেখানে এমন কিছু ঘটাই স্বাভাবিক। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরো বেশি নজরদারি করতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় নেতা বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হয়ে আমাদের এখানে এসেছে। তাদের বড় অংশই স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। তাদের এই অস্বাভাবিক আচরণ বাংলাদেশের জন্য মহা-বিপজ্জনক। তাই সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক থাকতে হবে। রোহিঙ্গাদের গতিবিধির ওপর সরকারের আরো নজরদারি বাড়াতে হবে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ আমার সংবাদকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এটিকে খুব অস্বাভাবিকভাবে নেয়া যাবে না। যেখানে ঘনবসতি সেখানে এমন ঘটনা ঘটাই স্বাভাবিক। রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের ভেতরে ঘটনা ঘটাচ্ছে স্থানীয়দের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তবে তাদেরকে একটা বেষ্টনীতে নিরাপদ জোনের মধ্যে রেখে নজরদারি বাড়ানো দরকার। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে, তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো সতর্কতা বাড়াতে হবে। তাদের আরো কঠোর নজরদারি করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্যাবাসন নিশ্চিত ছাড়া কোনোভাবে সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। তার আগ পর্যন্ত গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। যারা ক্যাম্পের ভেতরে অস্ত্র মাদকের ব্যবসা করছে, সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাদের সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমারসংবাদ

পাঠকের মতামত: