কক্সবাজার, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা ফেরাতে আঞ্চলিক চাপ বাড়ছে মিয়ানমারের ওপর

রাশেদ মেহেদী::

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর আঞ্চলিক চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে ভারত ও চীনের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। এ দুটি দেশের জোরালো ভূমিকার বিষয়টি সংকটের শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকার ক্ষেত্রেও চীনের অবস্থান বড় বাধা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের অবস্থানে অনেকখানি পরিবর্তন এসেছে। একই সঙ্গে ভারতও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ দুটি দেশের ভূমিকার পাশাপাশি আসিয়ানের মাধ্যমেও মিয়ানমারের প্রতি সংকট সমাধানের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। সংশ্নিষ্ট একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনই সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করবে। সংকট দীর্ঘায়িত হলে তা এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করবে। এ সত্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মিয়ানমারে নির্বাচন, করোনা মহামারিজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতা ও প্রভাববলয়ের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে চীনের ভূমিকায় অনেকখানি পরিবর্তন এনেছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত অক্টোবরে নেপিদো সফরে গিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দেন। ওই সফরের পর চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মিয়ানমারের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পর এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ আসবে। সূত্র জানায়, মিয়ানমারে নির্বাচনের পর চীনের পক্ষ থেকে দেশটিকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে আরও এক দফা বার্তা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে চীনের এ পদক্ষেপ সম্পর্কে বাংলাদেশকেও অবহিত করা হয়েছে। সর্বশেষ বার্তায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়টিতে কীভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উল্লেখ আছে।
সূত্র আরও জানায়, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ২০১৭ সাল থেকেই ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়, চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে- এ ধরনের একটি অবস্থা চলছিল। জো বাইডেনের আমলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় দেশ দুটির যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হচ্ছে। তারা যৌথ উদ্যোগ নিলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে। বিশেষ করে এর আগে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে মিয়ানমারকে চাপ দিতে নানা পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা। অন্যদিকে, চীন সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ নেয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। এ-সংক্রান্ত আলোচনার প্রস্তাবে ভেটো দেয় বেইজিং। রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার জন্য যে তহবিল, সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অংশীদারিত্বই বড়। চীনের অংশগ্রহণ তাদের তুলনায় ছিল নগণ্য। এখন চীনের ভূমিকায় পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হলে তা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্টই চাপ সৃষ্টি করবে।
অপর একটি কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আগের চেয়ে ভারতের অবস্থানেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আগে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছুটা নীরব ভূমিকায় থাকলেও সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের নতুন হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বিভিন্ন আলোচনায় স্পষ্ট করেই বলছেন, ভারতও মনে করে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই এ সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব। এ কারণে ভারতও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে কাজ করছে। গত ১৭ ডিসেম্বর দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বৈঠকেও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে এবং সেখানেও প্রত্যাবাসনে ভারতের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। ফলে ভারতের এই অবস্থানও মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসনে- এ সত্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালো করেই জানে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জরুরি মানবিক আশ্রয় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলোসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন যত দ্রুত সম্ভব নিশ্চিত করা। যদি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন সম্ভব না হয়, তাহলে উন্নত দেশ, যাদের অনেক জায়গা আছে, তাদের উচিত রোহিঙ্গাদের সেসব দেশে নিয়ে আশ্রয় দেওয়া। কারণ, বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা এককভাবে বহন করা দীর্ঘদিন ধরে সম্ভব নয়।

পাঠকের মতামত: