কক্সবাজার, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

সেলাই মেশিনে চলে রাবিয়ার সংসার

নিজস্ব প্রতিবেদক::

এক মুহূর্তের জন্যও যেন থেমে নেই তার সেলাই মেশিনের চাকা। বনবন করে ঘুরছে আর তার সাথে চলছে ধারালো সূচের ওঠানামা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা চোখদুটোর নজর সেই সূচের ওঠানামায় সেলাই পড়া কাপড়ের দিকে। এতটুকু হেরফের হওয়ার সুযোগ নেই। একটু পরপরই সূচের কাছাকাছি হাত বাড়িয়ে দিয়ে কাপড় সোজা করে দিতে হয়। এই বুঝি গেঁথে যাবে তীব্র গতিতে ওঠানামা করা সুঁই! কিন্তু যায় না। অথবা যায় কখনো কখনো। তাতে তোয়াক্কা নেই…

বলছিলাম কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের রাবিয়া বেগম (৩০)৷ তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে। স্বামী মোহাম্মদ সিরাজ ২০১৪ সালে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয় সুখের আশায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস সেখানে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। তখন বিপাকে পড়ে যায় রাবিয়ার সংসার। এ অবস্থায় সে পরের ঘরে দিনমজুর করে সংসার চালাতেন। তখন নুন আনতে পান্তা ফুরায়। পরে ইউনাইটেড পারপাসক খুঁজে বের করে রাবিয়াকে। সে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাসের সহযোগিতায় ইকরা প্রকল্পের আওতায় ৩৫ হাজার নগদ অর্থ পাই।

সেলাই কাজে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থাও করেন আইওএম এর অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস। প্রশিক্ষন পেয়ে ক্রয় করেন নতুন সেলাই মেশিন। যাতে অসহায় হতদরিদ্র রাবিয়া বেগম ঘুরে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে কাপড় সেলাই করা অর্থ দিয়ে তার সংসারে খরচ চালিয়ে যাচ্ছে। সেলাই মেশিনের চাকায় স্বপ্ন দেখছে রাবিয়া বেগম।

রাবিয়ার বড় মেয়ে জয়নাব আক্তার বলেন, আমার বয়স যখন ৪ বছর তখন বাবা সাগর পথে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয় কিন্তু সেখানে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। কেউ খোজঁ খবর রাখত না। মা তখন পরের ঘরে কাজ করে আমাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতেন। উনিই এখন আমাদের সংসারের এক মাত্র আয়ের উৎস। সেলাই এর কাজ করে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে যে অর্থ পায় তা দিয়েই আমাদের সংসার চলে৷

রাবিয়া বেগম বলেন, আমার স্বামীর মৃত্যুর পরে আমি একা, পরের ঘরে কাজ করে এতবড় সংসার আমার পক্ষে চালানো কঠিন হয়ে যেত, অনেক কষ্ট হতো। বর্তমানে আমি ইউনাইটেড পারপাসের সহযোগিতায় থ্রি-পিস, শার্ট এবং মিসকি ও ব্যাগ সেলাই করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করে সংসারে যোগান দি৷ ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যখন হারিয়ে ফেলছিলাম, ঠিক তখনই আলোর বার্তা নিয়ে পোড়া বাড়িতে হাজির আইওএম অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস।
তিনি আরও বলেন, আমি ২০২০ সাল থেকে ইকরা প্রকল্পের মাধ্যমে শাপলা দলের সদস্য হই। সেখানে প্রতিমাসে একশত টাকা করে সঞ্চয় করি। বর্তমানে আমরা ২৭ জন সদস্য আছি।

স্থানীয় অনেকেই বলেন, তিনি সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে স্বপ্ন বুনেন। সে বুননে তৈরি হয় সভ্যতা টিকিয়ে রাখার পোশাক-পরিচ্ছদ। অন্যের জীবনটাকে রঙ্গীন ও আনন্দময় করতেই তার টানা ঝুঁকিপূর্ণ পরিশ্রম। থ্রি-পিস, শার্ট এবং মেক্সি ও ব্যাগ সেলাই করেন। এসব পণ্য গ্রামে গ্রামে গিয়ে নিজেই আবার বিক্রিও করেন। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, শীত কিংবা গ্রীষ্ম কোনো কিছুতেই তার কাজের রুটিনে যেন পরিবর্তন আসে না।

জালিয়াপালং ইউনিয়নের পরিষদের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মুজাম্মেল বলেন, আমার ছেপটখালি এলাকায় রাবিয়া বেগমের মতো আরও অসংখ্য গরীব ও অসহায় মানুষের পাশে ছিলেন আইওএম ও ইউনাইটেড পারপাস। তাদের কাজের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এভাবে যদি আরও কাজ করলে অসহায় হতদরিদ্র মানুষের উন্নয়ন হবে।

জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নে আইওএম অর্থায়নে ইউনাইটেড পারপাস ৩৫ হাজার টাকা সহযোগিতা করেছে রাবিয়াকে। তবে রাবিয়া আরো সহযোগিতা পেলে অনেক বড় কিছু করতে পারতেন। রাবিয়ার মতো প্রায় সাড়ে পাঁচশত উপকার ভোগীকে সহযোগিতা করেছেন তাই আমার ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আইওএম ও ইউনাইটেড পারপাসকে ধন্যবাদ জানাই।

এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিজামুদ্দিন আহমেদ বলেন, কক্সবাজার জেলায় অনেক এনজিও-আইএনজিও কাজ করছে। তবে ইউনাইটেড পারপাসের কর্মকাণ্ড অন্যদের থেকে ভিন্ন। আমি আশাবাদী রাবেয়ার মতো উখিয়ার হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি সরঞ্জাম, কৌশল ও মূলধন হিসেবে আর্থিক সহযোগিতা করে তাদের উপকৃত করবে এনজিও-আইনজিওগুলো।

পাঠকের মতামত: