কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার প্রকল্পে উন্নয়ন হবে আট উপজেলার

বাংলা ট্রিবিউন :
 

মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির চাপ মোকাবিলায় বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। সম্প্রতি এই প্রকল্পের ব্যাপ্তি ও সময় বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কক্সবাজার জেলার আট উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দারাও সুবিধা নিতে পারবেন।

প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হবে ৫০টি সাইক্লোন শেল্টার। প্রাকৃতিক দুর্যোগে রোহিঙ্গাদের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকির পরিমাণ কমাতেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই ৫০টি সাইক্লোন শেল্টারে স্থানীয়রাও সুযোগ পাবেন। এর বাইরেও ওই এলাকার সড়ক উন্নয়ন, সেতু নির্মাণ, কালভার্ট, মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সেন্টার, সড়ক প্রশস্ত ও মজবুতকরণ, এফএসসিডি’র বিদ্যমান ফেসিলিটি উন্নয়ন, অগ্নিনির্বাপন যন্ত্রপাতি, পরিচালন ও মিনি পাইপে পানি সরবরাহ, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ কমিউনিটি ল্যাট্রিন, রক্ষণাবেক্ষণসহ বায়োগ্যাস ল্যাট্রিন, ওয়াটার অপশন স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণসহ পয়ঃনিস্কাশন ও কঠিন ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন, বিদ্যমান টয়লেট সংস্কারসহ বাসা-বাড়িতে বায়োফিল টয়লেট স্থাপন করা হবে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নিপীড়ন-নির্যাতনের সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত শিবিরে অবস্থান করছে। এতে সংশ্লিষ্ট উপজেলার জনসংখ্যা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যায়। এর ফলে সেখানকার বিদ্যমান অবকাঠামো যেমন- রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেন, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর চরম চাপ সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অগ্নিদুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও তারা অতিমাত্রায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

সেজন্য বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অনুদানে মোট এক হাজার ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ‘জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মাল্টি-সেক্টর প্রকল্প’টির অনুমোদন দেওয়া হয়।

স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি যৌথভাবে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরকে (ডিপিএইচই)। প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা ছিল, ২০২১ সালের নভেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু তা হয়নি। এ পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ১৭ শতাংশ। এর প্রায় দুই বছর পর ব্যয় ও বস্তবায়নের সময় বাড়িয়ে প্রকল্পটিতে প্রথম সংশোধনী এনে ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় আবারও অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।

প্রকল্পের সংশোধনীর কারণ সম্পর্কে একনেকে জানানো হয়েছে, শুরুতে কক্সবাজার জেলার দুটি উপজেলায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের টার্গেট নির্ধারিত ছিল। তবে পরবর্তীতে আরও ছয়টি উপজেলা সংযুক্ত করে মোট আট উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অনুদানের অতিরিক্ত অর্থায়নে বিদ্যমান উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিমাণ বাড়ানো ও নতুন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ, কেএফডব্লিউ ডেভেরপমেন্ট ব্যাংক কর্তৃক অতিরিক্ত অনুদানের অর্থায়নে জিওবি অর্থে ভ্যাট ও আইটি বাবদ অর্থের সংস্থান রাখা, এলজিইডি’র ২০১৯ সালের রেট শিডিউল কার্যকর হওয়ায় সে অনুযায়ী প্রকল্পের পূর্ত কার্যক্রমের ব্যয় প্রাক্কলন, স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে সহায়তার জন্য অতিরিক্ত ছয়টি উপজেলায় উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনজনিত কারণে আরপিএ অংশে সমন্বয় এবং প্রকল্পের কার্যপরিধি বৃদ্ধি পওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর সাত মাস বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমানো, সামাজিক সেবা প্রদান ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, অগ্নিজনিত দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমানো, শিক্ষার উন্নত সুযোগ সুবিধা প্রদান এবং বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে মিয়ানমার থেকে আসা আশ্রিতদের লিঙ্গভিত্তিক বলপ্রয়োগ প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণই হচ্ছে প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য।

চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, রামু, চকোরিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পেকুয়া এই আটটি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্প ব্যয় এক হাজার ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৯৮৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ২০ কোটি ৩৬ লাখ এবং প্রকল্প অনুদান বাবদ বিশ্বব্যাংক ও কেএফডব্লিউ থেকে পাওয়া যাবে এক হাজার ৯৬৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি (২০২০-২১) অর্থ বছরের এডিপিতে মোট ২০৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা (এর মধ্যে জিওবি ৫৫ লাখ প্রকল্প সাহায্য বাবদ ২০৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা) বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত আছে।

একনেকের অনুমোদনর জন্য পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া প্রকল্প প্রস্তাবনায় জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হবে ৫০টি। ২২২ দশমিক ৯৭ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন করা হবে। সেতু নির্মাণ করা হবে ৩৭১ মিটার। কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ৪৬৭ দশমিক ৫০ মিটার। মাল্টিপারপাস কমিউনিটি সেন্টার নির্মিত হবে ৩৪টি। সড়ক প্রশস্তকরণ ও মজবুতীকরণ করা হবে ৪২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ মিনি পাইপে পানি সরবরাহ ৬৬টি। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ কমিউনিটি লেট্রিন নির্মাণ করা হবে ৯০টি। পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণসহ বায়ো গ্যাস লেট্রিন নির্মাণ করা হবে ৩০টি। ওয়াটার অপশন স্থাপন করা হবে দুই হাজার ৫০০টি। বিদ্যমান টয়লেট সংস্কারসহ বাসাবাড়িতে টয়লেট স্থাপন ১৪ হাজার ৮০০টি। বাসাবাড়িতে বায়োফিল টয়লেট স্থাপন করা হবে দুই হাজার ৫০০টি।

পরিকল্পনা কমিশন মনে করে, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমানো, সামাজিক সেবা প্রদান ব্যবস্থার উন্নতি সাধন, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, অগ্নিজনিত দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি কমানো ও শিক্ষার উন্নত সুযোগ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির সংশোধন প্রস্তাব প্রণয়ন করা হয়েছে। এ সব দিক বিবেচনা করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি একনেক এর অনুমোদন পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, স্থানীয় জনগোষ্ঠিও উপকৃত হবে। আগে দুটি উপজেলায় বাস্তায়িত হলেও সংশোধনী প্রকল্পে আরও ছয়টি উপজেলাকে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে কক্সবাজার জেলার মোট আট উপজেলার জনসাধারণ উপকৃত হবে। এসব কারণেই প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়েছে।

পাঠকের মতামত: