কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা স্থানান্তরঃ প্রস্তুত ভাসানচর

চারদিকে সবুজের সমারোহ। গাছগাছালির ছায়ায় পাখির কলতান। সাদা বকের দল উড়ছে নির্বিঘ্নে। শত শত মহিষের পাল। জোয়ারের সময় পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছিল চরের তীরে। পুরো চর ঘিরে উঁচু বাঁধের সুরক্ষা ব্যবস্থা। এমন নৈসর্গিক পরিবেশে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক সব স্থাপনা। প্রকৃতি ও স্থাপনা মিলে সত্যি এক অপরূপ দৃশ্য। কোনো চর ঘিরে নয়নাভিরাম এমন দৃশ্য যেন কল্পনারও বাইরে।

মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে কক্সবাজার থেকে সাময়িকভাবে স্থানান্তরের জন্য এই ভাসানচরে এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে এক হাজার ৪৪০টি ক্লাস্টার হাউস ও ১২০টি শেল্টার স্টেশন। গুচ্ছগ্রামের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে এসব ক্লাস্টার হাউস। প্রতিটি ক্লাস্টার হাউসে ১২টি গৃহ। প্রতি গৃহে রয়েছে ১৬টি রুম। একেক রুমে চারজন থাকার ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য শতভাগ প্রস্তুত ভাসানচর। আধুনিক বর্জ্য ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাপনা, বায়োগ্যাস প্লান্ট ও সৌরবিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছেন। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অস্থায়ীভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ‘আশ্রয়ণ-৩’ নামে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। চরটি বসবাসের উপযোগী করা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বনায়ন ও দ্বীপটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রকল্পটির প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পর ভাসানচর ঘিরে আবাসন নির্মাণের লক্ষ্যে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতে সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা করে প্রণয়ন করা হয় ডিপিপি। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা। বাঁধ ও জেটি নির্মাণের জন্য পরে প্রকল্প ব্যয় তিন হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
‘আশ্রয়ণ-৩’ নামে প্রকল্পটির পরিচালক কমডোর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী জানান, ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হয়। প্রকল্পটি শেষ করার মেয়াদকাল ধরা হয় ২০১৯ সালের নভেম্বর। এক হাজার ৪৪০টি হাউস ও ১২০টি শেল্টার ৩০টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভাজন করে নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। নৌবাহিনীর অন্তত ২০০ সদস্য ও কনসালট্যান্ট ইঞ্জিনিয়াররা নির্মাণ কাজ তদারকি করেন। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে মূল ডিপিপির শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য :প্রকল্পটির উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার থেকে জোর করে বাস্তুচ্যুত এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য বসবাসের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা। দ্বীপটিতে সাময়িকভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হবে। তারা মিয়ানমারে তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশের ভূমিহীন ও দুস্থ নাগরিকদের ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হবে। চরটি সমুদ্রের মধ্যে থাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে চারদিকে এখন ৯ ফুট উচ্চতার বাঁধ রয়েছে। এটা ১৯ ফুট পর্যন্ত বাড়ানো হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে হাসপাতাল, বাজার ও খেলার মাঠ। রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের জন্য অভ্যন্তরীণ রাস্তা, পয়ঃনিস্কাশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে।

নয়নাভিরাম ভাসানচর :অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভূমি থেকে চার ফুট উঁচুতে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য প্রতিটি ক্লাস্টার হাউস ও শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে বসবাসকারীরা যাতে দুর্যোগকালীন আশ্রয় নিতে পারেন, সে জন্য রাখা হয়েছে একটি শেল্টার স্টেশন। যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ২৩টি পরিবার বসবাস করতে পারবে। প্রতিটি ক্লাস্টারে পুরুষ ও নারীদের আলাদা গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা আছে। ক্লাস্টার হাউসে রয়েছে রান্না করার সুব্যবস্থাও। ভাসানচরের শেল্টার স্টেশনগুলো স্টিল ও কংক্রিটের কম্পোজিট স্ট্রাকচারে তৈরি। বাস্তুচ্যুত হিসেবে রোহিঙ্গাদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা ভাসানচরে রয়েছে।
ভাসানচরের এই প্রকল্পে রয়েছে চারটি ওয়্যার হাউস। এক লাখ রোহিঙ্গার তিন মাসের ত্রাণসামগ্রী সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে সেখানে। প্রতিটি ক্লাস্টারের সঙ্গে রয়েছে একটি পুকুর। অগ্নিনির্বাপণের কাজেও পুকুরের পানি ব্যবহার করা যাবে।

নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য ভাসানচরে একটি গ্রামীণ ও একটি রবি মোবাইল বিটিএস স্থাপন করা হয়েছে। টেলিটকের নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজও চলছে। এক মেগাওয়াট হাইব্রিড সোলার প্যানেল, প্রয়োজনীয় পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন লাইন, একটি এক মেগাওয়াট জেনারেটর, দুটি ৫০০ কিলোওয়াটসহ মোট তিনটি ডিজেল জেনারেটর স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ থেকে দ্বীপটিকে সুরক্ষার জন্য ২ দশমিক ১ কিলোমিটর ‘স্কিন ব্রেকওয়াটারের’ মাধ্যমে ‘শোর প্রটেকশনের’ ব্যবস্থা হয়েছে। দ্বীপটিকে মালপত্র ও জনবল চলাচলের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় পন্টুন ও বোট ল্যান্ডিং সাইটের কাজও শেষ।

এই প্রকল্পের প্রতিটি ব্যারাক ঘরে রয়েছে পৃথক সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা। প্রতিটি শেল্টারে পাঁচ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আলাদা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে- যার মাধ্যমে শেল্টার স্টেশন আলোকিত করার পাশাপাশি সৌরপাম্প ব্যবহার করে পানি উত্তোলন করা সম্ভব।
বর্তমানে ভাসানচরের ক্লাস্টারে মোট ৩০৬ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৯৭, নারী ১৭৬ ও শিশু ৩৩ জন। চলতি বছরের শুরুতে বাংলাদেশের জলসীমা থেকে আটকের পর তাদের ভাসানচরে নির্মিত ক্লাস্টারে নিয়ে রাখা হয়।

ভাসানচরের ভৌগোলিক অবস্থান :ভাসানচর বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। এর আয়তন ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে সাড়ে ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। ভাসানচরে বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী ভূমি রয়েছে ছয় হাজার ৪২৭ একর। এর মধ্যে এক হাজার ৭০২ একর জমির ভেতরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার কাজে ৪৩২ একর ও ভবিষ্যতে সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য ৯১৮ একর ফাঁকা রাখা হয়েছে। ৩৫২ একর জমি ভবিষ্যতে নৌবাহিনীর ফরওয়ার্ড বেইস তৈরির জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।

কক্সবাজার ও ভাসানচরের সুবিধার তুলনামূলক চিত্র : প্রকল্প এলাকা ঘুরে এটা স্পষ্ট, রোহিঙ্গারা বর্তমানে কক্সবাজারে যে পরিবেশে রয়েছেন, তার তুলনায় ভাসানচরে আবাসনসহ অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো ও নিরাপদ। বর্তমানে কক্সবাজারে বিভিন্ন ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা বাঁশ ও টারপলিনের তৈরি ঘরে বসবাস করছেন। ভাসানচরে তৈরি করা হয়েছে মানসম্পন্ন ক্লাস্টার হাউস। ইউএনএইচসিআরের স্ট্যান্ডার্ড মেনে প্রতিটি ঘরের জন্য ৩ দশমিক ৯ বর্গমিটার জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

টেকনাফে অধিক জনবলের কারণে দিন দিন পানির স্তর কমছে। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থা সীমিত। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থা ছাড়াও পুকুর, খালের পানির ব্যবস্থা আছে ভাসানচরে। আবার বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। বর্তমানে কক্সবাজারে গড়ে আনুমানিক ২০ ব্যক্তির জন্য একটি টয়লেট ও ৮০ জনের জন্য একটি বাথরুম আছে। ভাসানচরে বিদ্যমান ব্যবস্থায় ১১ জনের জন্য একটি টয়লেট ও ১৬ জনের জন্য একটি বাথরুম ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যগুদামের অভাব, জায়গার সীমাবদ্ধতা ছাড়াও খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থায় জটিলতা আছে। ভাসানচরে বিশাল চারটি গুদামঘর তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নেই, স্ট্রিট লাইট অনুপস্থিত। অধিকাংশ অঞ্চল অন্ধকারাচ্ছন্ন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নিরাপত্তা বজায় রাখা খুব কঠিন। কিন্তু ভাসানচরে ডিজেল জেনারেটর, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থা, সৌরশক্তির মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, হাউস সোলারের ব্যবস্থা বিদ্যমান।
এ ছাড়া কক্সবাজারে জীবিকা নির্বাহের তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থাও নেই। অন্যদিকে ভাসানচরে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, মহিষসহ অন্যান্য পশু পালন ও পনির প্রক্রিয়াজাতকরণ, মৎস্য চাষ, পর্যটন শিল্প স্থাপন, অর্থনৈতিক জোন স্থাপন, ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণের সুযোগ রয়েছে। আবার কক্সবাজারের উচ্চ বনাঞ্চল এবং জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয়, উচ্চ বায়ুদূষণ, মাটিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানিদূষণের কারণে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। তবে ভাসানচরে রয়েছে বনায়নের বিশাল সুযোগ, মাটিক্ষয়, বায়ুদূষণের আশঙ্কা নেই। ভূমিধসের ঝুঁকিও থাকবে না। আবার কক্সবাজারে যানজট, সড়ক যোগাযোগ সীমিত, রাস্তা নির্মাণ ব্যয়বহুল। কিন্তু ভাসানচরে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এবং সব আশ্রয়কেন্দ্রে যানবাহন যাতায়াতের সুবিধা রয়েছে।

কক্সবাজারে ভূমিধসের উচ্চ ঝুঁকি থাকায় রোহিঙ্গাদের ঘরগুলো ঝুঁকির মধ্যে আছে। আবার ঘূর্ণিঝড়কালীন ঝুঁকি আরও বাড়বে। তবে ভাসানচরে ১২০টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এলেও রোহিঙ্গারা ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। এ ছাড়া কক্সবাজারে বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে পর্যটনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ভাসানচরে তাদের একাংশের স্থানান্তর হলে সেখানকার পর্যটনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আবার রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে থাকলে মানব ও মাদক পাচারে তাদের সংশ্নিষ্ট হওয়ার ঝু?ঁকি আরও বাড়তে পারে। ভাসানচরে স্থানান্তর হলে এটা নিয়ে আপাতত চিন্তার কোনো কারণ থাকবে না। কক্সবাজারে রোহিঙ্গারা রান্নার কাজে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বনের ওপর নির্ভরশীল। ভাসানটেকে রোহিঙ্গাদের জন্য বায়োগ্যাস প্লান্টের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: