কক্সবাজার, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস ৪ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

 

মিয়ানমার থেকে চার দফায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে র্দীঘ সময় অবস্থান করছেন। ফলে দেশে রোহিঙ্গারা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ের চূড়ায় এসব রোহিঙ্গাদের অবস্থান। তাদের শিবিরগুলো অরক্ষিত থাকায় রোহিঙ্গারা সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছেন।

তাই রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থাসহ আশ্রিতদের মধ্য থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরেরর কাজ শুরু করেছে সরকার। তবে দুই দেশ কিছু রোহিঙ্গার স্বদেশে প্রত্যাবাসনে একমত হলেও রোহিঙ্গাদের নানা শর্তে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

 

একে একে দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার। কিন্তু শর্ত না মানার অজুহাতে দীর্ঘ চার বছরেও আলোর মুখ দেখেনি এ প্রক্রিয়া।

 

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হয়ে আসা নতুন নয়। ১৯৭৮ সালে সর্বপ্রথম মিয়ানমারে থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে পালিয়ে আসে। এ সময় সেদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে সাড়ে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে কক্সবাজার, রামু, নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেন।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো সাহায্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল না। তাই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সরকার দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে দুই লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরত দেয়। এ সময় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থেকে যায়। এরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।

 

এর পর ১৯৯২ সালে আবারও নির্যাতনের মুখে আড়াই লাখের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তাার বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় ১৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। এ ক্যাম্পগুলোর বেশিরভাগ বন বিভাগের জমিতে স্থাপন করা হয়েছিল। পরে ২০১২ সালের জুনে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়লে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়।

এরপর ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন পুলিশ হতাহত হন। মিয়ানমার এ হামলায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে দাবি করেন। পরদিন হঠাৎ সেনারা সন্ত্রাসী দমনে রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে ধরপাকড়, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এতে রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসেন। এ সময় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ২৪টি পুলিশ ফাঁড়িতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। সে দেশে সেনারা সহিংসতার মুখে অপরাধী দমনের নামে শুরু হয় অভিযান। এতে প্রাণে বাঁচতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ সময় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় উখিয়া-টেকনাফে পাহাড় ও সমতলে। কক্সবাজারের দুই উপজেলায় ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া

কয়েকবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে। তার কোনোটিতে কি বাংলাদেশের সফল কূটনীতি প্রয়োগের পরিচয় পাওয়া যায়? প্রতিটি বৈঠকের পর পররাষ্ট্র দপ্তর আশা ব্যক্ত করেছে, এবার রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে। তালিকা হয়েছে রোহিঙ্গাদের। তালিকায় বদল এসেছে মিয়ানমারের মর্জিতে। অবশ্য সে তালিকায় রোহিঙ্গাদের সম্মতির ঘাটতি পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে দেশি-বিদেশি সংস্থার চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার ২০১৭ সালে ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এরপর দুই দেশের মধ্যে একাধিক বৈঠক হলেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। পরে এক বৈঠকে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর দিন ঠিক করা হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যথা সময়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

প্রথম দফায় রোহিঙ্গাদের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে পাঠানোর কথা ছিল। এ সময় মিয়ানমারে নিপীড়ন ও বৈষম্যের কারনে রোহিঙ্গারা স্ব-দেশে ফিরতে রাজি হয়নি। রোহিঙ্গাদের মাঝে ভয় ছিল তারা এভাবে ফেরত গেলে আবারও নির্যাতনের শিকার হবে। ফলে এবারের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থমকে যায়। ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো প্রত্যাবাসনের চেষ্টা শুরু করে সরকার। এবারও সবকিছু প্রস্তুত থাকলেও শেষ সময়ে এসেও আর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করা যায়নি।

 

তবে, সবশেষ বাংলাদেশ, মিয়ানমার আর চীনের পররাষ্ট্র সচিবদের অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি। তিন সচিব নিজ নিজ রাজধানী থেকে দেড় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করেন ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে। মূল আলোচনা হয় বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে, চীন মূলত সহায়কের ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের দেওয়া ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা থেকে মিয়ানমার এ যাবৎ ৪২ হাজার ৪০ জনের যাচাই-বাছাই শেষ করেছে এবং তার মধ্যে ২৭ হাজার ৬৪০ জন ‘মিয়ানমারে বাস করতেন’ বলে নিশ্চিত করেছে। বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এদের মধ্য থেকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব দিয়েছে তারা।

তালিকা পরীক্ষা করে বাংলাদেশ দেখেছে যে এটি একটি বিক্ষিপ্ত তালিকা। কারণ, ৮৪০ জন মানুষকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ১২টি গ্রাম থেকে। বাংলাদেশ প্রস্তাব দিয়েছে পুনর্বাসন তালিকা গ্রামভিত্তিক করার জন্য, যাতে পরস্পর পরিচিত লোকজন একসঙ্গে পুনর্বাসিত হতে পারে বলেও বৈঠকে বলা হয়।

নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা

বর্তমানে নতুন ও পুরাতন মিলিয়ে দুটি উপজেলায় ১১ লাখ ২৮ হাজার ৫৫৪ রোহিঙ্গা বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় রয়েছে। বর্তমানে সে কার্যক্রম বন্ধ। ইমিগ্রেশন বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদফতর রোহিঙ্গাদের এই কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তবে শিবির থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যাচেছ এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যার ফলে বায়ুমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গারা শিবিরে আছে কি না খতিয়ে দেখা জরুরি মনে করেন সচেতনমহল।

রোহিঙ্গাদের মাঝে বাড়ছে অপরাধ

পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গেল চার বছরের এই সময়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে হত্যা, গুমসহ নানা অপরাধে অন্তত ১ হাজার মামলা হয়েছে। তার মধ্যে চলতি বছর ছাড়া গেল তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে কমবেশি ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছেন ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে আছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি, হত্যা, মানব পাচার।

স্থানীয়দের আশঙ্কা

উখিয়া ও টেকনাফের সর্বত্র শরণার্থী শিবির। দুই উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। অথচ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। যা স্থানীয়দের চেয়ে দ্বিগুণ। এছাড়া দিন যতই গড়াচ্ছে, রোহিঙ্গা শিবিরে বাড়ছে অস্থিরতা। একই সঙ্গে বাড়ছে হত্যা, গুম, অপহরনসহ নানা অপরাধ। প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের কাছে কোনো না কোনো সমস্যায় পড়ছেন স্থানীয়রা।

টেকনাফ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিয়ানমারের মিথ্যাচারের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা এখন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে, এতে দেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তবে রোহিঙ্গার তৎপরতায় নানা সংকট তৈরি করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা হামিদুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, একে একে চারটি বছর পার হচ্ছে তবুও একজন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরানো যায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। সরকারের উচিত দৃশ্যমান কিছু করা। না হলে যে হারে রোহিঙ্গারা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে তাতে স্থানীয় বাসিন্দাদের বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে থাকবে এটা কিন্তু আমরা চাই না। বাংলাদেশ আমাদের বাড়ি নয়। চিরদিন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে থাকতে চাই না। আমরা নিজ দেশে ফিরতে চাই।

ক্যাম্পের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি শিবিরের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কাজ করছে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন। তবুও নিজেদের আধিপত্য নিয়ে যেসব সংঘাত বা হত্যাকাণ্ড ঘটছে তা দমনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পুলিশ।

পাঠকের মতামত: