কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

সিআরবি বাঁচলেই চট্টগ্রাম বাঁচবে

সবুজ-শ্যামল প্রাণ-প্রকৃতির শহর চট্টগ্রাম। ফুল, লতাপাতা ও বৃক্ষরাজির সমাহার শহরের বুকে মাথা ‍উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো। নগর বলতেই যাদের মনে ভেসে আসে ইট-পাথরের বড় বড় দালান আর যন্ত্রচালিত যানের ধোঁয়া-শব্দ। তারা দুদণ্ড শান্তি আর বৈচিত্র্য খুঁজে প্রাণ-প্রকৃতির অপার দানের এই শহর সিআরবির প্রকৃতিতে।

চট্টগ্রাম নগরীর ফুসফুস খ্যাত সিআরবি ইতিহাস-ঐতিহ্য সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই এলাকাটি ছোট-বড় পাহাড়-টিলার সমন্বয়ে মোট ২১০ একর জুড়ে বিস্তৃত। কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, এলাকাটি ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ।

চট্টগ্রামে প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়ার একটাই জায়গা সিআরবি। চট্টগ্রাম মহানগরীর ইতিহাস-ঐতিহ্য চট্টগ্রাম কেন বিশ্বব্যাপী এর পরিচিতি রয়েছে। সিআরবি ও তৎসংলগ্ন এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের নামে ঐতিহ্য ধ্বংস করে ইতিহাস না গড়ে আরেকবার ঐতিহ্য রক্ষায় বর্তমান প্রজন্মকে জানান দিতে হবে কোনো ঐতিহ্য ধ্বংস করা যাবে না। এটি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে একমাত্র উদ্যান, যেখানে নানা বয়সী, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ গিয়ে একটু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে।

হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দীর্ঘমেয়াদে রেলের কাছ থেকে এখানকার ছয় একর জায়গা লিজ নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে ঢাকার ইউনাইটেড গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে চট্টগ্রাম সিআরবিতে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিক্যাল কলেজ নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। বন্দরনগরীর চট্টগ্রামের রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সদরদপ্তর সংলগ্ন সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে রীতিমত ফুঁসে উঠেছে চট্টগ্রামবাসী। এর প্রতিবাদে সিআরবিতে গত জুলাইয়ের শুরু থেকে প্রতিদিন মানববন্ধন, বিক্ষোভ, প্রতিবাদী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

এ আন্দোলন শুধু দেশে নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। এই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশগত কারণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান, ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রজ্ঞাপন জারি করে, যাতে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করলে ২৫ জানুয়ারি, ২০০৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। উক্ত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের জোন-৩ এর ৮৩ সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র ও চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবিকে কালচার অ্যা হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সেটা রক্ষার জন্য ৮টি নির্দেশিকা প্রদান করা হয়। কালচার অ্যা হেরিটেজ এর ৮টি নির্দেশিকা বাস্তবায়নকারী হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি কর্পোরেশনসহ সেবাদানকারী সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিআরবি প্রোটেকটেড এরিয়া হিসেবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ সংবিধান পরিপন্থি। রেলের জমি সংরক্ষণ করার কথা রেল কর্তৃপক্ষের। উল্টো তারাই সে জমি দিয়ে দিচ্ছে আর আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে।

সিআরবির রয়েছে ঐতিহাসিক মূল্যও এসব স্থাপনা দেখতে সেখানে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় জমে। অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক মোহন ল্যান্ডস্কেপ এ সিআরবি। চৈত্র সংক্রান্তি, পয়লা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর মতো আবহমান বাংলার অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সিআরবির মায়াবী পরিবেশে। ডিসি হিলের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসার পর এ সবুজ প্রাকৃতিক মঞ্চ প্রাণবন্ত করে তোলেন সংস্কৃতি কর্মীরা।

গত ২০২১ সালের জুনে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় সিআরবি এলাকায় ১৯৭ ধরনের উদ্ভিদ শনাক্ত করেছিলেন গবেষক ওমর ফারুক রাসেল। জরিপে পাওয়া গেছে, মোট ২২৩ ধরনের উদ্ভিদ। এর মধ্যে ঔষধি গাছ আছে ১৮৩ ধরনের, বিপন্ন প্রায় আছে ৯ ধরনের এবং বিলুপ্ত হওয়ার পথে আছে ৬৬ ধরনের গাছ-গাছালি। এই এলাকায় যদি হাসপাতাল নির্মাণ হয়, তাহলে সব উদ্ভিদই ধ্বংস হয়ে যাবে। সিআরবিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাকসু) জিএস শহীদ আবদুর রবসহ অন্যান্য শহীদদের সমাধি। হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিচিহ্নও হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবশেষ পরিবেশপ্রেমী বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চট্টগ্রামবাসীর আকুল আবেদন সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশকে মুনাফালোভী বেনিয়াদের হাত থেকে রক্ষা করুন।

লেখক: মো: দিদারুল আলম প্রাবন্ধিক, পরিবেশ-অধিকারকর্মী

পাঠকের মতামত: