কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

সাগরলতা আমাদের যা দেখিয়ে দিল : ডিসি কামাল হোসেন

মোঃ কামাল হোসেন::

বৈশ্বিক মহাদুর্যোগে পর্যটকশূন্য বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। পড়ন্ত বিকেলে নির্জন সৈকতের দড়িয়ানগরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম বালিয়াড়ির বুকে সৃজিত সবুজ কার্পেটের আদলে সাগরলতাগুলো। সাগরলতা স্থানীয়দের ভাষায় ডাউঙ্গালতা কিংবা গঙ্গালতা অথবা পিয়াজলতা। যদিও সাগরলতার বৈজ্ঞানিক নাম Ipomoea pes-caprea। এটি Convolvulaceae গোত্রের উদ্ভিদ। এটির অন্য সাধারণ নাম বিচ মর্নিং গেস্নারি।

সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা। আর এ বালিয়াড়িই ঝড়–জলোচ্ছ্বাস ও সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ থেকে পরম মমতায় আগলে রাখে সমুদ্রসৈকত এবং সমুদ্রতীরের জনগোষ্ঠীকে।

মানচিত্রের ৩০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৩০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ এলাকার আমেরিকার ফ্লোরিডা, টেক্সাস, মেক্সিকো, জর্জিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া, ক্যারিবিয়ান এলাকা, বাংলাদেশসহ উপকূলীয় কয়েকটি দেশের সমুদ্রপারে এটির দেখা মেলে। কক্সবাজার ছাড়াও পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটাতেও দেখা যায় সাগরলতা। আমেরিকায় এ লতাকে railroad vine বলে থাকে। এর সামগ্রিক চেহারা ঠিক রেলপথ ট্রাকের মতো। এ উদ্ভিদ বেলেমাটি পছন্দ করে এবং এমনকি সৈকতের উত্তপ্ত বালুতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জন্মায়। এক কথায় বলা যায়, সাগরলতা অতি খরা সহনশীল উদ্ভিদ।

সাগরলতা সৈকতে বালু স্থিতিশীলতার কাজ করে থাকে। কারণ, এটি বালুর গভীরে তিন ফুট পর্যন্ত শিকড় পাঠাতে পারে। এ লতা এত দ্রুত বর্ধনশীল যে দিনে এক ফুট পর্যন্ত বাড়তে পারে। সাগরলতা ১০০ ফুটের বেশি লম্বা হতে পারে অনায়াসে। আশপাশের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকলে চারদিকে বাড়তে থাকে এবং বালিয়াড়িতে জাল বিস্তার করে মাটিকে শক্ত করে আটকে রাখে। এর ওপর বায়ু প্রবাহের সঙ্গে আসা বালু প্রতিনিয়ত জমা করে মাটির উচ্চতা বৃদ্ধি করে তৈরি করে বালিয়াড়ি। কক্সবাজারের প্রবীণ সাংবাদিক তোফায়েল আহমেদ সাগরলতার অতীত শুনিয়েছিলেন আগ্রহভরে।

বালিয়াড়িকে কক্সবাজারের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘ডেইল’। সমুদ্রতীরের বাসিন্দারা এ ধরনের বালিয়াড়িকে ঘিরেই একসময় তৈরি করত লোকালয়। জেলার কিছু পাড়ার নাম দেখলে এটি বোঝা যায়। যেমন কুতুবদিয়ার আলী আকবর ডেইল, কক্সবাজার পৌরসভার ফদনার ডেইল, উখিয়ার জালিয়াপালংয়ের ডেইলপাড়া, টেকনাফের মুন্ডার ডেইল, সেন্ট মার্টিনের ডেইলপাড়া, ইমামের ডেইল প্রভৃতি। স্থানীয় প্রবীণদের কাছ থেকে জানা যায়, সমুদ্রসৈকতের নাজিরারটেক থেকে কলাতলী পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ, ৫০০ ফুট প্রশস্ত ও কমবেশি ৩০ ফুট উচ্চতার একটি ডেইল ছিল। কক্সবাজারের অধিবাসী পরিবেশবিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিমের মতে, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতে ২০-৩০ ফুট উঁচু বালুর ঢিবি বা ডেইল ছিল, আর ডেইলজুড়ে ছিল বিস্তৃত সাগরলতা, যার অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই সৈকতজুড়ে ঝাউগাছ রোপণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে থেকে আজ অবধি সমুদ্রসৈকতের নুনিয়ারছড়া থেকে টেকনাফের সাবরাং পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার জুড়ে বেশ কয়েকটি স্থানে তৈরি হয়েছে ঝাউগাছের বন, যা আজও সমুদ্রের ভাঙন রোধে নিরাপত্তাপ্রাচীরের মতো কাজ করছে। তারপরও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অ্যান্টার্কটিকায় হিমবাহ গলে যাওয়া প্রভৃতি নানা কারণে পানির উচ্চতা বেড়েছে সমুদ্রে। স্বাভাবিকভাবে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়। জলোচ্ছ্বাসের তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙে যায় সমুদ্রের পার। গত বছর কবিতা চত্বর পয়েন্টে বেশ কিছু ঝাউগাছ সমুদ্রের ভাঙনে বিলীন হয়েছে।

এসব থেকে সুরক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র উপকূলজুড়ে ঝাউগাছ রোপণের নির্দেশ দিয়েছেন। বন বিভাগ কক্সবাজার জেলায় ‘সবুজ বেষ্টনী সৃজন, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার এবং ইকো ট্যুরিজম উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় ঝাউগাছ রোপণের কাজটি করে যাচ্ছে। যাহোক, সামান্য পরিসরে হলেও লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলী, দড়িয়ানগর, হিমছড়িসহ সমুদ্রসৈকতের কিছু এলাকায় সাগরলতা আজও টিকে আছে।

সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশিকে আটকে বালুর পাহাড় বা বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা।

আহমেদ গিয়াসকে সবাই চারণ সাংবাদিক হিসেবে জানেন। দড়িয়ানগরের সাগরপারেই তাঁর বসতি। দু-তিন মাস ধরে সাগরলতা কেটে কেটে খালি জায়গায় রোপণ করেছেন তিনি। তাঁর রোপণ করা সাগরলতা কিছুটা বিস্তৃতিও লাভ করেছে। নতুন পাতা এসেছে লতায়। ব্যক্তিগত ভালো লাগা থেকে, পরিবেশ–প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি সাগরলতার পরিচর্যা করছেন, স্বপ্ন দেখছেন বালিয়াড়ি সৃষ্টির।

বলতে গেলে গত ১৮ মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে পর্যটকদের আসা–যাওয়া বন্ধ রয়েছে কক্সবাজারে। এ বিরল নির্জনতার সুযোগে সাগরপারের পরিবেশের অন্যতম সদস্য সাগরলতা হয়েছে নবযৌবনা, মেলেছে গাঢ় সবুজ ডানা। এর ফুলগুলো বড় ও ফানেল আকৃতির, রং বেগুনি থেকে বেগুনি-গোলাপি। পাতাগুলো রসাল এবং বৃত্তাকার খাঁজকাটা টিপের মতো দেখতে। এই টিপ কিছুটা ‘ছাগলের পায়ের’ মতো দেখায় বলে ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছে ‘পেস ক্যাপ্রে’।

সাগরলতা সৈকতে বালু স্থিতিশীলতার কাজ করে থাকে। ছবি: প্রথম আলোসৈকতের বালুরাশির ওপর রেলপথের মতো বহমান লতার চারপাশে বিস্তৃত পুরু ভারী সবুজ পাতা আর তার মাঝে বেগুনি কিংবা বেগুনি-গোলাপি ফুলের সমাহার দেখলেই জুড়িয়ে যায় প্রাণ। শোভিত ফুল মৌমাছি, প্রজাপতি, পতঙ্গ, মাছি, পিঁপড়াকে আকর্ষণ করে। সাগরলতার গাড় সবুজ পাতা মাটিকে সূর্যের কিরণ থেকে এমনভাবে রক্ষা করে, যাতে সূর্যের তাপ মাটি থেকে অতিরিক্ত পানি বাষ্পীভূত করতে না পারে। এভাবেই মাটির নিচের স্তরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াসহ প্রাণিকুলের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেয় সাগরলতা। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের শরীর জেলিফিশের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে সাগরলতার পাতার রস ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে স্থানীয়ভাবে ক্ষত সারানোর জন্য। তাই পরিবেশবিজ্ঞানীরা মনে করেন, সাগরলতা ও বালিয়াড়ি না থাকলে বহু প্রাণী পরিবেশ থেকে হারিয়ে যাবে।

আহমেদ গিয়াস জানালেন, কিছুদিন ধরে মানুষের পদচিহ্ন না পড়ায় লাল কাঁকড়ায় ভরে গেছে সাগরপারের অনেক এলাকা। ডিম পারতে আসছে নানা প্রজাতির কচ্ছপ। আর ডলফিনের উচ্ছল নৃত্যে আন্দোলিত সাগরের পানি। সাগরলতা নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন। সৈকত রক্ষা এবং এর পরিবেশগত উপকারিতার কথা ভেবে প্রাথমিকভাবে তিনি পরিকল্পনা করেন, দড়িয়ানগর থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত তিন কিলোমিটার এলাকার যেখানে সাগরলতা নেই, সেখানে তা রোপণ করা হবে। টেক্সাসের মতো আমাদের নার্সারি না থাকলেও লতা কেটে এর চাষ করা যাবে, পরবর্তী সময়ে বীজ সংগ্রহ করা হবে। রোপণের এখনই উপযুক্ত সময়। এর ঠিক পেছনের অংশে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হবে নারকেলগাছ। আবার পর্যটকের পদভারে সৈকত মুখরিত হলেও এ তিন কিলোমিটারে তাদের নামতে দেওয়ার বিষয়টি সীমিত করা হবে।

পরিকল্পনার কথা শুনে আশ্বস্ত করলাম তাঁকে। সেই সঙ্গে দায়িত্ব নিতে বললাম স্থানীয়দের সমন্বয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটি গঠন করে সাগরলতা দেখভাল ও পরিচর্যার। করোনার এই মহাদুর্যোগে সবাই যখন শঙ্কিত, আতঙ্কিত, তখনই সমুদ্রপারের সাগরলতা পেয়েছে নতুন প্রাণ। আমাদের হাতে–কলমে শিখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে আমরা পরিবেশ ধ্বংসের কারণ হয়েছি। সাগরলতার নতুন প্রাণ আমাদের কঠিনভাবে আরও জানিয়ে দিল, আমরা মানুষ পৃথিবীতে না থাকলেও পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না; বরং থাকলে অসুন্দর হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তারপরও থেমে যাক পৃথিবীজুড়ে চলা মৃত্যুর মিছিল, বেঁচে থাকুক মানবসভ্যতা। প্রকৃতিকে ভালোবাসি, নিজেদের বাঁচার জন্যই।

লেখক: জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার।

পাঠকের মতামত: