কক্সবাজার, সোমবার, ৬ মে ২০২৪

প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক নেতাদের খুন করা হচ্ছে

‘নসরুল্লাহ নবী’ গ্রুপের হাতে জিম্মি ৩৩ রোহিঙ্গা শিবির

কিছুদিন পর পর পুরো আশ্রয় ক্যাম্প অশান্ত করে তোলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসা। তারা আবারও নতুন করে দল ভারি করতে রোহিঙ্গা যুবকদের আরসার সদস্য হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ করছে। নবী হোসেন নামে এক রোহিঙ্গা মৌলবি আরসা নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরকে অশান্ত করে তুলছে। তিন বছর আগে আরএসও ছেড়ে ‘নসরুল্লাহ নবী’ গ্রুপ তৈরি করে দলে সদস্য সংখ্যা বাড়ায় নবী হোসেন। টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা শিবির জিম্মি করে রেখেছে আরসা ও নবী গ্রুপের ক্যাডাররা। প্রত্যাবাসনে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নেতাদের খুন করে চলেছে তারা।
মৌলবি নবী হোসেন ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়।

সেখানে মাদ্রাসায় চাকরি করে দীর্ঘদিন। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন আতঙ্কের নাম এই নবী বাহিনী। আরসার সক্রিয় নেতা হলেও নবী হোসেন নিজস্ব গ্রুপ সৃষ্টি করে তাদের ক্ষমতার জানান দিচ্ছে সাধারণ রোহিঙ্গাদের। উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঁচ শ’ সদস্যের বাহিনী গড়ে তুলেছে এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। আরসার সমর্থন নতুবা নিজস্ব বাহিনী দিয়ে অপরাধ করায় নবী হোসেন। সাবেক আরএসও কমান্ডার নবী উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে আশ্রিত মোস্তাক আহমেদের পুত্র। মিয়ানমারের মংডু ঢেকিবনিয়া এলাকায় তাদের আদিনিবাস। মৌলবি আরেফ আহমেদ ও দিল মোহাম্মদ নামে দুই আরসা কমান্ডার মিয়ানমারের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত রোহিঙ্গা বস্তিতে থাকে। তাদের মাধ্যমে অস্ত্র ও ইয়াবার চালান পাঠানো হয় উখিয়া টেকনাফের আশ্রয় ক্যাম্পে। তার এসব খবর গোয়েন্দা নজরদারিতে চলে আসায় সুচতুর নবী হোসেন পাড়ি দেয় মিয়ানমারে। সেখানে সেনা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে সেনা কর্মকর্তাদের অংশীদারিত্বে থাকা ইয়াবা কারখানাগুলো থেকে বড় চালান এনে তাদের ফ্যাক্টরি চালু রেখেছে এই নবী হোসেন। কিছুদিন আগে কয়েকটি মাদকের বড় চালান নিয়ে আসে বাংলাদেশে। এরমধ্যে শহরের অদূরে চৌফলদ্ডী উপকূলে সাড়ে ১৪ লাখ পিস ইয়াবার একটি বড় চালান ধরা পড়ে কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের জালে। তৎকালীন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওসি মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে এই মাদকের চালানসহ কারবারিদের আটক করা হয়। এ সময় জব্দ করা হয়েছিল কয়েক বস্তা টাকা। এখনও ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে বলে সূত্র আভাস দিয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক ও অস্ত্র আনে নবী হোসেন। খোদ মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) কিছু সদস্য নবী হোসেনকে অস্ত্র ও ইয়াবার চালান সরবরাহ করে। গত চার মাস আগে তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বাংলাদেশ সীমান্তের দায়িত্বে কাজ করা সরকারী একটি বাহিনী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একটি চৌকসদল এখনও খবর রাখছে নবী হোসেনের গতিবিধি। তবে কোনভাবেই তাকে ধরা যাচ্ছে না। সাগরপথে কোটি কোটি টাকার মাদকের চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও ইয়াবার চালান বাংলাদেশে নিয়ে আসে ইয়াবা ডন নবী হোসেন। নদীপথে আসা চালানগুলো ঢুকানো হয় আশ্রয় ক্যাম্পে। মাছ ধরার ফিশিং বোট যোগে সাগরপথে আনা চালানগুলো নেয়া হয় চট্টগ্রামের গহীরা, আনোয়ারা, পটিয়া ও ঢাকার নারায়ণগঞ্জে। এসব ইয়াবা ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার বড় চালান নিয়ে আসতে তাকে দেশটির সেনাবাহিনীর সদস্যরা শেল্টার দেয়ায় সীমান্তে অভিযান চালানো যাচ্ছে না।

মিয়ানমারের জিরো লাইনে অবস্থিত বস্তিসহ উখিয়া টেকনাফের ৬টি ক্যাম্পে তার যাতায়াত রয়েছে গোপনে। তার পাঁচ শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে। সবার কাছে রয়েছে বাংলাদেশী সিমযুক্ত মোবাইল ফোন ও কয়েকটি ওয়াকিটকি। মিয়ানমারের বিজিপির সহায়তায় সে দেশের মোঃ হালিম নামে এক কোম্পানির মাধ্যমে ইয়াবার চালান আনছে দেশে। ইতোপূর্বে হালিমের ভাগিনা সাইফুল করিম দেশে আনত ইয়াবার চালান। এই সাইফুল করিমের সঙ্গে ওসিসহ বড় বড় রাঘববোয়ালদের সম্পর্ক ছিল। এমনকি একাধিক সাংবাদিককে বাড়ি-গাড়ি করে দিয়েছে এই সাইফুল। যা এখনও দৃশ্যমান। টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সেই হাজী সাইফুল করিমের স্থলাভিষিক্ত হয় নবী হোসেন। ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ছেড়ে নবী নিজস্ব গ্রুপ তৈরি করে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে।

আরসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে খুনখারাবি করতে থাকে। এ তথ্য জেনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দায়িত্বরত একটি সংস্থার পক্ষ থেকে ওই নবী হোসেনের অপরাধ কর্মকান্ড নিয়ে উচ্চপর্যায়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। প্রতিবেদনে মিয়ানমার থেকে নবী হোসেন গ্রুপের মাদকের বড় চালান দেশে আনার বিষয়টি উঠে এসেছে। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা ¯্র্েরাতে নবী হোসেনের পরিবারও পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় উখিয়ার কুতুপালংয়ে। তখনও নবী হোসেন ছিল মালয়েশিয়াতে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের শেষের দিকে কুতুপালং আসে নবী হোসেন। তবে ক্যাম্পের রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ হয়নি তার নাম। ইস্যু করা হয়নি তার নামে রোহিঙ্গা আইডি কার্ডও। ক্যাম্পে এসে আরসার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মাদকের চালানে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার ইশারায় দেশে আসছে। উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নবী হোসেন গ্রুপের সদস্যরা সীমান্তে গিয়ে কৌশলে নিয়ে আসে ইয়াবার চালান।

উখিয়া টেকনাফ ক্যাম্পে আশ্রিত নবী হোসেন বাহিনীর সদস্যরা হচ্ছে- সামছু আলম, মোঃ রফিক, হামিদ হোসেন, মোঃ সেলিম, মোঃ আনোয়ার, মোঃ জোবাইর, মোঃ ইসমাইল, হোসেন আহম্মদ, হাফেজ ইদ্রিস, মোঃ আয়াস, মোহাম্মদ আমিন, কামাল হোসেন, ইব্রাহিম, আবুল কাসম, মোঃ ইসমাইল, কবির আহমেদ, হারুনর রশিদ, মোঃ সেলিমউল্লাহ, মোঃ জুনায়েদ, হোসেন জোহার, আনোয়ারা বেগম, নুরতাজ বেগম, শাহেরা জান্নাত, মিনারা বেগম, রবিউল ইসলাম, আবদুল আমিন, বদি আলম ও মোঃ শফিক। সুত্র; জনকন্ঠ

পাঠকের মতামত: