কক্সবাজার, শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি এবং বাংলাদেশের কূটনীতি

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মাঝে-মধ্যেই তিনি শিরোনাম হন। এবার অবশ্য প্রেক্ষাপট ভিন্ন। শিক্ষক কাম কূটনীতিক ড. মোমেন কথা বলতে বড্ড বেশি পছন্দ করেন। যদিও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কথা বলতে হয় মেপে মেপে। কিন্তু মোমেন এর ব্যতিক্রম। ক্যামেরার সামনে গেলে তিনি ডিপ্লোমেসি ভুলে যান। রাজনীতিবিদদের মতো পল্টনের ভাষায় বক্তৃতা করেন।

শনিবার এমন এক বক্তব্য রাখলেন যা নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচনা হচ্ছে। শাসক আওয়ামী লীগের ভেতরেও নানামুখী আলোচনা চলছে। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে (যদিও আয়োজকরা তা বলেননি)  হোটেল সোনারগাঁওয়ে আয়োজন করা হয় এক বিশেষ অনুষ্ঠান। সেখানে সেনাপ্রধানও  বক্তৃতা করেন। তার বক্তৃতা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। অনুষ্ঠান শেষে ড. মোমেন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে তিনি বলেন, জাতিসংঘের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান গুমের তালিকায় যে লোকজনের নাম দিয়েছিল তাদের অনেকের ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আসল কারণ নয়। বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তাই অনেক দেশ গুমের প্রসঙ্গটি সামনে এনে চাপ প্রয়োগ করে স্বার্থ হাসিল করতে চায়। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কাদের সলিল সমাধি হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। নিশ্চয় এর একটা তালিকা রয়েছে মন্ত্রীর কাছে। মন্ত্রী ইচ্ছা করলে তালিকাটা প্রকাশ করতে পারেন। মন্ত্রীর এই যুক্তি শুধু হাস্যকরই নয়, এটা কূটনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ। কেন বাংলাদেশি নাগরিকরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন এটা মন্ত্রীর অজানা থাকার কথা নয়। এই প্রশ্নও উঠেছে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ৩৭তম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশি নাগরিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে চান। এটা আমরা সবাই জানি এদের রক্তে ঘামেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। গত বছর অন্তত ৮ হাজার ৬৬৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক বিপজ্জনক, অনিয়মিত রুট দিয়ে ইউরোপের দেশে প্রবেশ করেছে। ড. মোমেন এমন এক সময় এই বক্তব্য রাখলেন যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বহাল। জাতিসংঘের গুম বিষয়ক বিশেষ কমিটির বৈঠক বসছে। সেখানে বাংলাদেশসহ ২৪টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে। মন্ত্রীর বক্তব্যে প্রচণ্ড রাগ প্রকাশ পেয়েছে। আর তা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে। কিন্তু তিনি কি ভুলে গেছেন কূটনীতিতে আবেগ বা রাগের কোনো স্থান নেই। মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক কংগ্রেসনাল কমিটির চেয়ার গ্রেগোরি ডাব্লিউ মিকসের বক্তব্য নিয়ে উল্লাস মাঝপথে থেমে যাওয়ার কারণেই তিনি অনেকটা হতাশ, ক্ষুব্ধ। কংগ্রেসম্যানের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তার এক সহকর্মী উল্লাস প্রকাশ করেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কংগ্রেসম্যান বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা না দিলে হয়তো উল্লাস চলতো অনাদিকাল। গ্রেগোরি মিকস তার বক্তব্য মিসকোট করা হয়েছে ভদ্রতার খাতিরে তা অবশ্য উল্লেখ করেননি। তবে তার বক্তব্য খোলাসা করেছেন। বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তার কোনো ভিন্ন মত নেই। বাইডেন প্রশাসন যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তাতে তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ হবে এই আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন।

কার টাকা পানিতে গেল জানি না, শুধু এটুকু বুঝি এতে করে আমাদের কূটনীতির দৈন্যতা প্রকাশ পেয়েছে। মেলাকাল কূটনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে আমাদের কূটনীতিকদের দেখার সুযোগ হয়েছে। এক সময় যখন আমাদের অর্থনীতি ছিল দুর্বল। পৃথিবীর অনেক দেশ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। তখন এই কূটনীতিকরাই বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করেছেন। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশি কূটনীতিকদের অবস্থান ছিল আলাদা। কিন্তু অবাক হয়েছি, ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস প্রধান শহিদুল ইসলামের মতো কূটনীতিক কি করে একটি তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানের খবর দূতাবাসের তরফে মিডিয়ায় পাঠালেন। অথচ দূতাবাসের কোনো প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। এখন কি হলো? দূতাবাসের ওয়েবসাইটে অবশ্য আর গ্রেগোরি মিকসের বক্তব্য সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি দেখা যাচ্ছে না। আসলে কূটনীতিকরা সস্তা রাজনীতির কাছে হেরে গেছেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন একজন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কূটনীতিক। দেশ-বিদেশে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। তিনিও আবেগতাড়িত হয়েছেন এমনটাই বলা যায়। যদিও ধীর-স্থির, শান্ত এ মানুষটি কূটনীতির মারপ্যাঁচ ভালোভাবেই রপ্ত করেছেন। তার শুরুটা দেখার সুযোগ হয়েছিল। আমি তখন বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলাম। যাই হোক, শহিদুল ইসলামের ভাগ্য বিপর্যয় হতে চলেছে। এ নিয়েই এখন বলাবলি হচ্ছে। তিনি কি একাই এর জন্য দায়ী? নিষেধাজ্ঞা তো একদিনে হয়নি। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে।

১৯৯০ সনে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ চলছে। ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিশেষ খাতির। সামরিক সহযোগিতা চেয়ে বসলেন। তখন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সৌদি আরব কুয়েতের সঙ্গে অ্যালায়েন্সে যোগ দিয়েছে। প্রশ্ন উঠলো, হলি মক্কায় সৈন্য পাঠানো নিয়ে। ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারিক আজিজ বার কয়েক ফোন করলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। বললেন, ইরাকের স্বার্থ যেন দেখা হয়। এরশাদ তখন দোটানায়। শেষ পর্যন্ত পবিত্র স্থান রক্ষায় চার হাজার বাংলাদেশি সৈন্য পাঠানো হয়। সেদিন বিশেষ খাতির আর আবেগ বাংলাদেশকে কাবু করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই ভালো এবং বহুমুখী। ব্যবসা-বাণিজ্য শুধু নয়, চলমান করোনা মহামারির সময়ে মানবিক সাহায্য হিসেবে টিকা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। কোন প্রেক্ষাপটে র‌্যাবসহ ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে পর্যালোচনা করে এর সমাধান খুঁজতে হবে। তা না করে আমরা যদি ভূ-রাজনীতির খেলায় ভুল পথে হাঁটি তাহলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। নিষেধাজ্ঞার ডালপালা কিন্তু অনেক। বিজিএমইএ নেতারা যতই বলেন না কেন সংকট হবে না- সব ঠিক আছে, বাস্তবে তা ঠিক নেই। চিঠি কিন্তু অনেকেই পেয়ে গেছেন।

এরশাদের জমানায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এআরএস দোহা এক সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছিলেন। ১৯৮২ সনের নভেম্বরে এরশাদ যাবেন চীনে। এর আগে ২৩শে নভেম্বর দৈনিক ইত্তেফাককে এক সাক্ষাৎকার দেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বন্ধুত্বের সংজ্ঞায়িত করেন। বলেন, মুসলিম বিশ্বই আমাদের প্রথম বন্ধু। দ্বিতীয় বন্ধু চীনসহ প্রতিবেশী দেশসমূহ। তৃতীয় স্থানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ। এটা ছাপা হওয়ার পর শক্তিধর জেনারেল এরশাদের ডানহাত হিসেবে পরিচিত নাজিরুল আজিজ চিশতি আমাকে ডেকে পাঠান। বলেন, দোহা সাহেব অস্বীকার করছেন। বলেছেন, তিনি এমন কথা বলেননি। এখন আপনার জেলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কারণ এরশাদ সাহেব ক্ষুব্ধ হয়েছেন।  আমি বললাম, আমার কাছে টেপ আছে। টেপ আনতে বললেন। টেপ হাজির করার পর প্রেসিডেন্ট এরশাদ শান্ত হলেন বটে, কিন্তু দোহার ওপর রাগ বেড়ে গেল তার। চটজলদি দোহাকে সরাননি তবে কয়েক মাসের মধ্যেই তাকে সরিয়ে দেন।

শেষকথা, কূটনীতিকদের কাজ করতে দিন। অবশ্যই রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা থাকবে। এখানে দেশের স্বার্থ বড়। সরকার আসবে, যাবে। ভুল চাল নতুন কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে।

পাঠকের মতামত: