কক্সবাজার, শনিবার, ৪ মে ২০২৪

মেজর সিনহা হত্যার পর ‘বন্দুকযুদ্ধশূন্য’ মেরিন ড্রাইভ

মুহিববুল্লাহ মুহিব, কক্সবাজার::

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুর পর ওই সড়কে আর কোনো কথিত বন্দুকযুদ্ধ হয়নি।

পুলিশ বলছে, মাদক কারবারিরা এখন তাদের গুলি করে না। ফলে তাদেরও পাল্টা গুলি করতে হচ্ছে না।

সিনহার মৃত্যুর আগের দুটি বছর ছিল রক্তাক্ত। এই সময়ে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ গেছে অন্তত ৫৬ জনের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বিশেষ মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৮৭ জন।

এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে ১৭৪ জন, বিজিবির গুলিতে ৬২ ও র‌্যাবের গুলিতে ৫১ জন নিহত হন।

এই সময়ে কেবল কক্সবাজারের উপজেলা টেকনাফেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ১৬১ জন। তার মধ্যে শুধু মেরিন ড্রাইভের বিভিন্ন অংশে যারা মারা যান, তাদের সিংহভাগই সিনহা হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

সিনহা হত্যার আগে এত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর হত্যার পর একটি ঘটনাও না ঘটার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক কারবারিও এখন আর পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে না। তাই আমাদেরও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালাতে হয় না। মূলত এখন তেমন প্রয়োজন হয় না তাই বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে না। সেটি ছাড়াও কিন্তু বড় ইয়াবার চালান উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।’

মানবাধিকার ও সুশাসন ইস্যুতে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘সিনহা হত্যার আগে কেন এমন ঘটনা ঘটত, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে এখন। এই হত্যার পর যদি বন্দুকযুদ্ধ ছাড়াই ইয়াবার বড় চালান ধরা সম্ভব হয়, তাহলে বলতে হয়- এখানে আগে যে বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে, আগে ব্যক্তিস্বার্থ বা কারও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমরা বলতে চাই- এ দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়।’

সিনহা হত্যার পর কেবল কক্সবাজারের সেই সড়কেই নয়, সারা দেশেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণহানি কমেছে।

২০১৬ সালে দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৭৭ জনের মৃত্যু হয় বলে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কমে ১৪১ জনে নেমে আসে৷ ২০১৮ সালে তা আবার বাড়ে। ওই বছরে নিহত হয় ৪২১ জন৷ ২০১৯ সালে নিহত হয় ৩৭৪ জন৷ ২০২০ সালে তা কমে হয় ১৮৮ জনে। এই মৃত্যুর বেশির ভাগই হয়েছিল সিনহা হত্যার আগে। আর সদ্যসমাপ্ত বছর ২০২১ সালে তা আরও কমে হয় ৫১ জন।

সিনহা হত্যা

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র বানানোর জন্য প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকার একটি রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন। ওই কাজে তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।

কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেকপোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করেন।

কিন্তু ওই বছরের ৫ আগস্ট সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র‌্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।

সিনহা নিহতের ছয় দিন পর লিয়াকত আলী, প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে এই হত্যায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানিয়ে টেকনাফ থানার করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আসামিদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

প্রায় সাড়ে চার মাস তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ কক্সবাজারের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

এই মামলার আসামিদের সাজা ঘোষণার কথা সোমবার।

পাঠকের মতামত: