কক্সবাজার, রোববার, ৫ মে ২০২৪

রোহিঙ্গা শিবিরে উঁকি দিচ্ছে বিপদ

মিয়ানমারে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে রোহিঙ্গারা। সমুদ্র তীরবর্তী জেলা কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গার বাস। যদিও বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ^ব্যাপী তা-ব চালানো করোনা ভাইরাস এবার হানা দিয়েছে অসহায় মানুষগুলোর মাথা গোঁজার শিবিরেও। পাঁচ রোহিঙ্গার করোনা ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কারণ ঘিঞ্জি ঝুপড়ি ঘরে লাখ লাখ মানুষের বাসস্থান হওয়ায় করোনা ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের হটস্পট হয়ে উঠতে পারে রোহিঙ্গা শিবিরসহ কক্সবাজার জেলা। দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ৬৬ দিন পর কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোভিড-১৯ রোগী ধরা পড়ে। গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের পিসিআর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষায় দুজন রোহিঙ্গার করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। তারা দুজনই পুরুষ এবং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের রোহিঙ্গা। তাদের একজন উখিয়ার লম্বাশিয়া এলাকার ১ নম্বর পশ্চিম ক্যাম্পের বাসিন্দা। তাকে আইওএমের ২ নম্বর ক্যাম্পের পশ্চিম ব্লকে স্থাপিত আইসোলেশন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অন্যজন কুতুপালং ১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা। তাকেও তাৎক্ষণিক এমএসএফের ওসিআই আইসোলেশন হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নতুন করে গতকাল আরও তিন রোহিঙ্গার দেহে করোনার সন্ধান মিলেছে বলে নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর

ডা. অনুপম বড়ুয়া।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে করোনা শনাক্তের পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আক্রান্তদের আশপাশের বেশকিছু ঘর লকডাউন করা হয়েছে। রোহিঙ্গা শরাণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের (আরআরআরসি) অফিসের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী ডা. আবু মো. তোহা ভূঁইয়া জানান, করোনা আক্রান্তদের পরিবারের সদস্য ও তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। সবার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, এখন জরুরি ভিত্তিতে ক্যাম্পের সবার মানসম্মত মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আজেবাজে মাস্ক নয়। সামাজিক দূরত্ব সেখানে বজায় রাখা কঠিন হবে। এর পরও যতটা সম্ভব এটা বজায় রাখতে হবে। সাবানের ফেনা তুলে বারবার হাত ধুতে হবে। সর্দি-জ¦র কাশি থাকলে সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করাতে হবে। সরকারকে ওখানে বড় করে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে যারাই সংক্রমিত হবে তাদের আইসোলেশনে পাঠানো যায়। কারণ ওখানে হোম কোয়ারেন্টিনের সুযোগ নেই। এ সবের ব্যত্যয় ঘটলে অতিদ্রুত সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিরই হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়বে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। এ নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। ছোট্ট একটা এলাকায় প্রায় ১২ লাখ লোকের বাস। ছোট ছোট পলিথিনে বাঁধা ঘর, একটার সঙ্গে আরেকটা বাঁধা। একটা ল্যাট্রিন অনেক মানুষ ব্যবহার করে। ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনা করে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংস্পর্শে কারা গেছে তাদের আলাদা করে ক্যাম্পের একটু দূরে আইসোলেশনে পাঠানোর বিকল্প নেই। উপসর্গ দেখা দেওয়া মাত্রই যদি আইসোলেশনে না নেওয়া যায় তা হলে এর ফল ভয়াবহ হতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে তাদের দেখভালকারী ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকারের এখন নৈতিক দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেবাটা নিশ্চিত করা।
কক্সবাজার শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, আক্রান্ত একজন রোহিঙ্গা কুতুপালং ক্যাম্প-১ এর লম্বাশিয়ার বাসিন্দা। প্রথমবারের মতো আক্রান্ত এ রোহিঙ্গার পরিবারের সদস্য ছাড়াও আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের আলাদা করা হবে। তিনি আরও বলেন, ক্যাম্পে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউএনএইচসিআর, আইওএমসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার পরিচালিত হাসপাতালে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসাইন বলেন, রোহিঙ্গা করোনা রোগীকে শনাক্ত করে পরীক্ষার জন্য সহায়তা করেছে পুলিশ। আক্রান্ত ব্যক্তির থাকার জায়গা লকডাউনের পাশাপাশি ক্যাম্পের কেউ যাতে বাইরে যেতে না পারে সে জন্য সাতটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তবে শুধু চেকপোস্ট বসিয়ে রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন তিনি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সাইফ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ক্যাম্প ইনচার্জদের সতর্ক করা হয়েছে। যাতে কোনো রোহিঙ্গা আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে নজরদারি করা হচ্ছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয়কে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পৃথক দুটি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আলম বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে গাদাগাদি করে বসবাস করায় এমনিতেই এখানে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি বেশি। এ অবস্থায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানে এটি আমাদের জন্য আরও দুঃসংবাদ।
এদিকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র আন্দ্রেজ মাহেজিক বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কারোনার বিস্তার ঠেকানোর জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং এর জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তিনি বলেন, করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে র‌্যাপিড তদন্ত দল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, তারা কীভাবে করোনা আক্রান্ত হলেন, সেটি খতিয়ে দেখছে। রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত এপ্রিল থেকে রোহিঙ্গাদের করোনা টেস্টিং শুরু হয়েছে, এখন পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়েছে ১০৮ জনের নমুনা।

করোনা বিস্তারের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়ে আন্দ্রেজ মাহেজিক বলেন, খুবই অল্প জায়গায় প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণ বাস করছে। এটি একটি বড় ঝুঁকি। তাই এদের মানবিক সমস্যার জন্য যে যৌথ রেসপন্স পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, সেটি বাস্তবায়নের

পাঠকের মতামত: