কক্সবাজার, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

রোহিঙ্গা সংকট: বিপাকে বাংলাদেশ

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশ। মানবিকতা দেখাতে গিয়ে তাদের আশ্রয় দেয়াই যেন কাল হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে সংকটে রূপ নিচ্ছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি। একের পর এক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে ক্যাম্পে ও ক্যাম্পের বাইরে থাকা এই জনগোষ্ঠীর লোকজন। বন উজাড়, মাদক পাচার, চোরাকারবারি, খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী ও অস্ত্রের ব্যবসাসহ সব ধরনের অপকর্মে সিদ্ধহস্ত এরা।

এরই মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে রোববার ভোরে আধিপত্য বিস্তারের জেরে রোহিঙ্গা দুই গ্রুপের সংঘর্ষে দুজন নিহত ও সাতজন আহত হয়েছেন। এর ঠিক দুই দিন আগেই শুক্রবার রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন গহীন পাহাড়ে অস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধান পায় র‍্যাব। বিশেষ অভিযান চালিয়ে দুজন অস্ত্রের কারিগরসহ তিনটি অস্ত্র, দুই রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত ও চীন বিশেষ নীরবতা পালন করছে। মুখে মুখে সংকট নিরসনের আশ্বাস দিলেও আদতে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে সৌদি আরবে অবস্থানরত অন্তত ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে চাপ দিচ্ছে দেশটি। এমনকি তাদের পাসপোর্ট দেয়া না হলে দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের হুমকিও দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন।

একই সঙ্গে দিন দিন রোহিঙ্গাদের জন্য আসা আন্তর্জাতিক সহায়তার পরিমাণও কমছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ চাপের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও পড়ছে সরকার। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তাদের খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হবে।

এছাড়া ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে এই রোহিঙ্গারা। যা দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিরও কারণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এমনকি অবৈধ পন্থায় বাংলাদেশের নাগরিক সনদ বা ভোটার আইডি কার্ড করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ অপকর্ম ঠেকাতে নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থাও। জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেছেন, ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে বিশেষ কমিটি করা হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক তথ্যসহ আলাদা রোহিঙ্গা ডাটাবেজ স্থাপন করা হয়েছে।

সম্প্রতি জাতিসংঘের ভার্চুয়াল সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণের অনুরোধ জানান তিনি।

ওই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি জোরপূর্বক পাঠানো বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিককে আশ্রয় প্রদান করেছে। তিন বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও এখন পর্যন্ত মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয়নি। এই সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্টি এবং এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে।

এদিকে সৌদি চাপের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেন, সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এবং রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখে আশি-নব্বইয়ের দশকে অনেক রোহিঙ্গাকে দেশটিতে নিয়ে যান। অনেকে সরাসরি গেছে, আবার কেউ কেউ হয়তো বাংলাদেশ হয়ে গেছে। এটি আমরা পুরোপুরি জানি না। সৌদি আরব বলছে, এই সংখ্যা ৫৪ হাজার। সেখানে তাদের পরিবার আছে। তাদের ছেলেমেয়েরা কখনোই বাংলাদেশে আসেনি। তারা সৌদি সংস্কৃতি জানে এবং আরবি ভাষায় কথা বলে। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সৌদি সরকার প্রথমে বলেছিল, এই সংখ্যা ৪৬২ জন এবং তারা কারাগারে আছে। নাগরিকত্ব যাচাই-বাছাই শেষে বাংলাদেশ এদের ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিল। পরে যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে দেখা যায়, এদের অধিকাংশের কোনো কাগজ নেই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এরপর তারা (সৌদি আরব) বলল ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে আছে। এদের কোনো পাসপোর্ট নেই কিংবা কোনো কাগজ নেই। তারা বলছে, এদের তোমরা পাসপোর্ট ইস্যু করো। আমরা বলেছি, যারা আগে পাসপোর্ট পেয়েছে এবং তাদের পাসপোর্টের কাগজ যদি থাকে, তবে আমরা নতুন পাসপোর্ট ইস্যু করব। কিন্তু এরা যদি আমাদের লোক না হয়, তবে আমরা নেব না।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেয়া না হলে বাংলাদেশের লোকজনকে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে আবদুল মোমেন বলেন, কনিষ্ঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছে, তোমরা যদি এদের না নাও বা পাসপোর্ট ইস্যু না কর, তবে তোমাদের দেশ থেকে এত লোক আনা হচ্ছে, এটা আমরা বন্ধ করে দেব। তোমাদের যে ২২ লাখ লোক এখানে আছে, তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক অবস্থান নেব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৌদি আরবের বর্তমান অবস্থান অন্যায্য। রোহিঙ্গা বিষয়ের সঙ্গে প্রবাসী কর্মীদের যুক্ত করাটা অনৈতিক চাপ। এ বিষয়ে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটে প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান, যা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আর এ প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সমস্যার মূল কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তা নিষ্পত্তি, যথোপযুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে। তিনি গত ১৬ সেপ্টেম্বর ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সাম্প্রতিক চার বছর: টেকসই সমাধান নিশ্চিতের চ্যালেঞ্জসমূহ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সাইড ইভেন্টে এসব বলেন।

এদিকে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়েরকৃত মামলায় সহায়তা করার ঘোষণা দিয়েছে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। আন্তর্জাতিকভাবে এটি অর্জন হলেও কার্যত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সরাসরি কথা বলছে না কোনো দেশ।

এর আগে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা

পাঠকের মতামত: